৭ দিনের আল্টিমেটাম “যশোর-বেনাপোল সড়কের গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাতিল করা না হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে”
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েই যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা অপরিহার্য। অথচ যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক সম্প্রসারণের জন্য রাস্তার দুই পাশের ২ হাজার ৩ শতের অধিক গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্তে বিষয়টি উপেক্ষিত। তাই অবিলম্বে ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি যশোর জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাতিল করা, প্রকল্পের টেন্ডার কার্যক্রম বন্ধ করা এবং মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এক সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত  গ্রহণ করা এবং তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করার দাবী জানানো হয়। অন্যথায় বিভিন্ন পেশাজীবি, সামাজিক, নাগরিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনসহ সুশীল সামাজের ব্যক্তিবর্গ এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে জানিয়েছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ ১৯টি পরিবেশবাদী সমমনা সংগঠনের নেতা কর্মীরা। আজ ১৬ জানুয়ারী ২০১৮, মঙ্গলবার, সকাল ১১ টায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ মোট ১৯টি পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে “যশোর বেনাপোল সড়কের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাতিল কর”-দাবীতে মানববন্ধনে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান-এর সভাপতিত্বে উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, গবেষক ও লেখক বারসিকের পাভেল পার্থ, পবা’র সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ, স্টেট ইউনিভার্সিটির বিভাগীয় প্রধান স্থপতি সাজ্জাদুর রশিদ, প্ল্যান্ট এক্সচেঞ্জ এন্ড কেয়ার-এর উপদেষ্টা শামীমা জাহান তুলি, পবা’র সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, জেবুন নেসা, সুবন্ধন সমাজ কল্যাণ সংগঠনের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব, বিসিএইচআরডি-এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুল হক, এক্টিভিস্ট মাসুদুল হাসান জায়েদী, নোঙর-এর সভাপতি সুমন শামস, ঐবাঁক-এর আহ্বায়ক নূরিতা নুসরাত খন্দকার, লেখক কামরুজ্জামান ভূঁইয়া প্রমুখ। 
 
প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ যশোর-খুলনা মহাসড়কের যশোর অংশের ৩৮ কিলোমিটার ও যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ৩৮ দশমিক ২০০ কিলোমিটার পুননির্মাণের জন্য যথাক্রমে ৩২১ কোটি ৫৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা ও ৩২৮ কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা (মোট ৬৫০ কোটি ৪৮ লাখ ৭৩ হাজার টাকা) ব্যয়ে দুটি প্রকল্প গ্রহণ করে। যশোর-খুলনা মহাসড়কে ২ হাজার ৫৫৫টি গাছ এবং যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে ২ হাজার ৩১২টি গাছ (মোট ৪ হাজার ৮৬৭টি গাছ) কাটা পড়বে। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে  ২ শতের অধিক গাছ রয়েছে যেগুলোর বয়স ১৭০ বছরের বেশি। প্রকল্প দুটি ২০১৭ সালের মার্চ মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদিত হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে মহাসড়কের দুই পাশের গাছ কাটার কথা বলা হলে বিভিন্ন মহল থেকে বাঁধা আসে। এ বাঁধার মুখে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় কোনো গাছ না কেটে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগকে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। 
 
তিনি আরো বলেন যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের গাছগুলো আমাদের ঐতিহ্য। গাছগুলোর সাথে জড়িয়ে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। এগুলো কেটে ফেললে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা চাই গাছগুলোকে আইল্যান্ডে রেখে মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা হোক। এতে ঐতিহ্য রক্ষা পাবে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যও সংরক্ষিত হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবেশি দেশের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভ’মি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’
২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি যশোর জেলা প্রশাসকের সভা কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। কেননা যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দুই পাশের গাছগুলো অক্ষত রেখে মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা সম্ভব। যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং জীব-বৈচিত্র্য, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন ছয়টি দেশের একটি। সুতরাং এদেশে যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের আগে পরিবেশগত প্রভাব নিরুপণ করা অত্যন্ত জরুরি। অথচ উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে।
অন্যান্য বক্তারা বলেন, প্রথম আলোয় ২০১৭ সালের ২১ জুলাই প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে “কোনো গাছ না কেটে পুননির্মাণ করা হবে যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ক। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগকে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এর আগে মহাসড়কটির দুই পাশের বিভিন্ন প্রজাতির ২ হাজার ৩১২টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”
 
কোনো গাছ না কেটে যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ক পুননির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ডিপিপি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হলেও  ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি যশোর জেলা প্রশাসকের সভা কক্ষে “যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক যথাযথ মানে ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের আওতায় রাস্তার দুই পার্শ্বের গাছসমূহ অপসারণ বিষয়ে" অনুষ্ঠিত সভায় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সবাই ‘জনস্বার্থে গাছ কাটা’ বিষয়ে একমত হন। সভা শেষে সড়ক ও জনপথ বিভাগের যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দুই পাশের ছোট-বড় মিলিয়ে ২ হাজার ৩ শত গাছ কেটে সড়ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফলে গাছ কেটেই সড়ক সম্প্রসারণ করা হবে। প্রথমে গাছ কেটে মহাসড়ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে গাছ রেখেই মহাসড়ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়। সড়ক ও জনপথ থেকে আপত্তি জানালে আবার গাছ কেটে সড়ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়।
 
সড়ক ও জনপথের যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বিবিসি বাংলাকে ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ বলেন যেভাবে প্রকল্পটি অনুমোদন হয়েছে ঠিক সেভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে গাছ কাটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তিনি আরো বলেন রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য টেন্ডার অনুমোদনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। জানুয়ারিতে অনুমোদন হলে ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। 
 
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরুপণ (ইআএ) প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ২ হাজার ৩১২টি গাছ কাটা নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর নিরব ভূমিকা পালন করছে। যা জনগণের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক সম্প্রসারণের নামে গাছ কাটার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং বিভিন্ন পেশাজীবি, পরিবেশবাদী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণকে পরিবেশ বিনষ্টকারী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানাচ্ছি। 
 
সুপারিশ
 
ক্স ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি যশোর জেলা প্রশাসকের সভা কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাতিল করা।
ক্স যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের টেন্ডার কার্যক্রম অনতিবিলম্বে বন্ধ করা।
ক্স পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলায় মহাসড়কের দুই পাশের গাছগুলো রেখে মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা। 
ক্স যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দুই পাশের গাছগুলো অক্ষত রেখে সড়ক ও জনপথ বিভাগ কর্তৃক মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ক্স ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত বাতিল করা, প্রকল্পের টেন্ডার কার্যক্রম বন্ধ করা এবং মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এক সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত  গ্রহণ করা এবং তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা।
ক্স সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সড়ক ও জনপথ বিভাগ কর্তৃক দীর্ঘ প্রায় ৬ মাসে মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ না করার কারণ চিহ্নিতকরণ এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ক্স পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দুই পাশের গাছ কাটা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর ভ’মিকা পালন করা।