পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তায় পলিথিন নিষিদ্ধের আইন অকার্যকর
পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্যের উপর পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দলমত নির্বিশেষে দেশের সর্বস্তরের জনগণ তা সানন্দে গ্রহণ করে। এই আইন বাস্তবায়নের ফলে পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। কিন্তু বর্তমানে সারা দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিনের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর হয়তো ভুলেই গেছে যে, আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং সেই আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদেরই। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তায় বর্তমানে পলিথিন নিষিদ্ধের আইনটি সম্পূর্ণ অকার্যকর  হয়ে পড়েছে। আজ ২০ জানুয়ারী ২০১৮, শনিবার, সকাল ১১ টায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ মোট ১৭টি পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে “পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন কর”-দাবীতে মানববন্ধনে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান-এর সভাপতিত্বে উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, পবা’র সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ, সদস্য মো. সেলিম, ক্যামেলিয়া চৌধুরী, স্থপতি জুবাইদা গুলশান আরা, নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ এর সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, নোঙর-এর সভাপতি সুমন শামস, বানিপা-এর সভাপতি প্রকৌ. মো. আনোয়ার হোসেন, বিসিএইচআরডি-এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুল হক, বিডি ক্লিক-এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, সচেতন নগরবাসী-এর সভাপতি জি. এম. রোস্তম খান, নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি হাজী শেখ আনসার আলী, শীতলক্ষ্যা নদী বাঁচাও আন্দোলন-এর আহবায়ক বোরহান মেহেদী, সমন্বয়ক মাহাবুব সৈয়দ, পবা’র সদস্য আবু বক্কর সিদ্দিক, রতন মজুমদার, এলিজা রহমান, আদিবাসী যুব পরিষদ-এর সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং, নাসফের সদস্য প্রকৌ. মো. কামাল পাশা মিয়া প্রমুখ। 
 
প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরীর প্রায় এক হাজার দুই শত কারখানা রয়েছে। এগুলোর বেশীর ভাগই পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক। পুরান ঢাকার অলি-গলিতে রয়েছে প্রায় তিন শত কারখানা। কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, টঙ্গীতে ছোট-বড় বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। ঢাকা ও আশেপাশের এলাকা ছাড়াও চট্রগ্রামসহ জেলা শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে শত শত পলিথিন কারখানা। পলিথিন বাজারজাতকরণে পরিবহন সিন্ডিকেট নামে আরেকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। ‘জরুরী রফতানি কাজে নিয়োজিত’ লেখা ট্রাকে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। 
 
পরিবেশ ও বন মন্ত্রী গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আবদুস সোবহান বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধের আইন প্রণয়নের পর তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের ফলে বিকল্পের চাহিদা দেখা দেয় এবং তা বাজারে চলে আসে। জনগণও তা গ্রহণ করে। আইনের প্রয়োগ শিথিল হওয়ার সাথে সাথে বিকল্পের চাহিদা কমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা শূণ্যের কোটায় নেমে আসে। নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন বন্ধ হলে বিকল্পের চাহিদা সৃষ্টি হবে এবং তা বাজারে চলে আসবে। যে সব সুবিধার অপব্যবহার করে নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন উৎপাদন, বিপণন করা হচ্ছে তা দেখভাল করার দায়িত্বও তাঁর মন্ত্রণালয়াধীন পরিবেশ অধিদপ্তরের। পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা। পাশা পাশি রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব।
গত ১১ জানুয়ারি অনলাইনে পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের প্রকাশিত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আবদুস সোবহান আরো বলেন, ২০০২ সালে আইনটি ভাল করে স্টাডি করা না হয়ে থাকলে গত ১৫ বছরে তিনি বা তাঁর অধিদপ্তর আইনটি সংশোধনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি কেন? বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত রুটিন ওয়ার্ক তথা বাজারে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব হবে না। প্রয়োজন পলিথিন উৎপাদান বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যেখানে জনগণ তাঁদের কোনো কার্যক্রম দেখতে পাচ্ছে না। এই আইন যতক্ষণ বলবৎ আছে ততক্ষণ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হিসিবে তাঁরা তা বাস্তবায়নে সক্রিয় র্ভমিকা পালন করবেন এটাই জনগণের প্রত্যাশা। বাংলাদেশ পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকারী প্রথম দেশ। বর্তমানে বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ও ব্যবহার হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য ও শহরে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 
 
অন্যান্য বক্তারা বলেন, ২০০২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ সংশোধন করে পলিথিন উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইনের অধীন প্রদত্ত নির্দেশ লংঘনজনিত অপরাধের ক্ষেত্রে কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০ সংশোধন করে পলিথিন শপিং ব্যাগ সংক্রান্ত অপরাধসমূহের ব্যাপারে অনুসন্ধান, কোন স্থানে প্রবেশ, কোন কিছু আটক, আনুষ্ঠানিক তদন্ত ও অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ এবং প্রয়োজনবোধে পরিবেশ আদালত বা স্পেশাল ম্যাজিষ্ট্রেট এর আদালতে পরিবেশ আদালত আইন অনুযায়ী মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের এস আই/সমপর্যায় হতে এ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ পর্যন্ত; মেট্রোপলিটন বহির্ভূত এলাকায় এস আই/সমপর্যায় হতে সহকারী পুলিশ সুপার পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তাগণকে উক্ত আইনে সংজ্ঞায়িত “পরিদর্শক” এর ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
 
কাপড়ের মতো দেখতে এক ধরনের রঙিন পলিথিন টিস্যু (যা চায়না টিস্যু নামে পরিচিত) ব্যাগে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। পরিবেশবান্ধব পাটজাত দ্রব্য, কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙা, কাপড়ের ব্যাগ ইত্যাদি সহজলভ্য বিকল্প থাকা সত্ত্বেও আইন অমান্য করে নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, মজুত, পরিবহন, বিপণন, বাজারজাত ও ব্যবহার করা হচ্ছে। রফতানিকৃত পণ্যের বাজারজাত, প্যাকেজিং, নার্সারির চারা, রেণুপোনা পরিবহন এবং মাশরুম চাষের ক্ষেত্রে পলিথিন উৎপাদনের ছাড়পত্র নিয়ে পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরী করে বাজারজাত করা হচ্ছে। পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানীকৃত পলি প্রোপাইলিন ব্যবহৃত হচ্ছে। 
 
ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটির বেশী পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশী টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ পলিথিনের হলেও কাপড়ের ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। শপিং মল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কাপড়ের দোকান, জুতার দোকান, ফ্যাশন হাউজ, বিভিন্ন কোম্পানিসহ সারা দেশের বাণিজ্যিক বিতানগুলো টিস্যু ব্যাগ ব্যবহার করছে। নিষিদ্ধ পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ফলে কাগজ, পাট ও কাপড়ের ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এতে হাজার হাজার ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বিশেষ করে নারী-শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।
 
করণীয় : 
ক্স পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় ভ’মিকা পালন করা।
ক্স পলিথিন শপিং ব্যাগ ও টিস্যু ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। 
ক্স নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
ক্স পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা  ইত্যাদি সহজলভ্য করা এবং এগুলো ব্যবহারে জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করা।
ক্স বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানীকৃত পলি প্রোপাইলিন পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ক্স টিস্যু ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল আমদানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ক্স পরিবেশ অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
ক্স পরিবেশ অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।