গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা সম্প্রসারণ কর- মানিকগঞ্জসহ সারাদেশে রাস্তার গাছ হত্যা বন্ধ কর
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন ছয়টি দেশের একটি। মূলত সে কারণেই এদেশে যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের আগে পরিবেশগত প্রভাব নিরুপণ করা অত্যন্ত জরুরি। অথচ উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে। উন্নয়নের নামে রাস্তা সম্প্রসারণে রাস্তার দু’পাশের প্রাচীন ও বৃহৎ গাছ কাটার মহোৎসব চলছে। সম্প্রতি যশোর-বেনাপোল সড়কের পরপরই মানিকগঞ্জ-সিঙ্গাইর-হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের ৩ হাজার ৭২৫ টি গাছ কাটছে জেলা পরিষদ। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে গাছ কাটার কাজ। এভাবে গাছ কেটে নিধন করলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এসকল কর্মকান্ডে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিরব ভূমিকাই প্রধান কারণ বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। তারা মনে করেন, মানিকগঞ্জসহ সারাদেমে গাছ না কেটে রাস্তার উন্নয়ন সম্প্রসারণ বা সম্প্রসারণ সম্ভব। আজ ২৭ জানুয়ারী ২০১৮, শনিবার, সকাল ১১ টায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ মোট ২১টি পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে “গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা সম্প্রসারণ কর; মানিকগঞ্জসহ সারাদেশে রাস্তার গাছ হত্যা বন্ধ কর”-দাবীতে মানববন্ধনে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
 
পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্ত্বে উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, পবা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান, সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ, নাসফের সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী, জনউদ্যোগের সদস্য সচিব তারিক হাসান, পবা’র সদস্য মো. সেলিম, ক্যামেলিয়া চৌধুরী, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ-এর সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, নোঙর-এর সভাপতি সুমন শামস, বিডি-ক্লিক-এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, বানিপা’র সভাপতি ইঞ্জি. আনোয়ার হোসেন, সচেতন নগরবাসী’র সভাপতি জি এম রোস্তম খান, ঐবাঁক-এর আহ্বায়ক নূরিতা নুসরাত খন্দকার, ইয়ুথ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন, নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি শেখ আনসার আলী, বাঁচাও শীতলক্ষ্যা নদী আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহাবুব সৈয়দ, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক সৈয়দা অনন্যা রহমান, আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং প্রমুখ। 
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, মানিকগঞ্জসহ সারাদেশে গাছ না কেটে আইল্যান্ডে অথবা বিকল্প উপায়ে রাস্তার উন্নয়ন বা সম্প্রসারণ করা সম্ভব। সে প্রয়াস না নিয়ে কিছু স্বার্থেন্বেষী মহল প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ বান্ধব ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করে রাস্তা প্রশস্ত বা উন্নয়নের নামে নির্বিচারে গাছ হত্যা করছে। আমরা সেই সমস্ত দোষী ব্যাক্তিদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবী জানাচ্ছি। 
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন ‘সংবিধান’। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভ’মি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করা। সারা দেশে সড়ক নির্মাণ, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ; শিল্পকারখানা স্থাপন; শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা এবং শহর এলাকায় বিশেষ করে ঢাকা শহরে সড়ক ও ফুটপাত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ; বিদ্যুত লাইনের নিরাপত্তা বিধানের নামে গাছ কাটার এক মহোৎসব চলছে। এর পাশাপাশি প্রায় ৪ হাজার ৯শত ইটভাটায় ৩০ লাখ টনের বেশি কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। যা সংবিধান পরিপন্থী। এসকল উন্নয়ন কর্মকান্ডে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই গাছ রেখে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং জীব-বৈচিত্র্য, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে। পরিবেশকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন কর্মকান্ডই টেকসই হতে পারে না, হবেও না এবং এধরনের কর্মকান্ড ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্য দুর্যোগ বয়ে আনবে।
তিনি আরো বলেন, ঢাকার হেমায়েতপুর থেকে মানিকগঞ্জ সিঙ্গাইর এলাকায় আঞ্চলিক মহাসড়কের ৩ হাজার ৭২৫টিরও বেশি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং ইতিমধ্যে সহস্রাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ঢাকার হেমায়েতপুর থেকে মানিকগঞ্জ সিঙ্গাইর এলাকায় আঞ্চলিক মহাসড়কের গাছগুলো কেটে ফেলা হলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। গাছগুলো মহাসড়কের একপাশে ও আইল্যান্ডে রেখে মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা সম্ভব। এতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্য পরিবেশ সংরক্ষিত হবে এবং জীববৈচিত্র্য, বন ও বন্যপ্রাণির নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। দেশে গাছ লাগনো আজ একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হলেও পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে তার কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বিচারে গাছ কাটা এবং ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো। 
 
তিনি বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ঢাকার হেমায়েতপুর থেকে মানিকগঞ্জ সিঙ্গাইর এলাকায় আঞ্চলিক মহাসড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরুপণ প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ঢাকার হেমায়েতপুর থেকে মানিকগঞ্জ সিঙ্গাইর এলাকায় আঞ্চলিক মহাসড়কের প্রায় ৪ হাজার গাছ কেটে মহাসড়ক সম্প্রসারণের বিষয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা ও প্রতিবাদ হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর নিরব ভূমিকা পালন করছে। যা জনগণের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
 
অন্যান্য বক্তারা বলেন, যশোর-মহাসড়ক সম্প্রসারিত করার নামে হাজারো গাছ হত্যার প্রতিবাদে অনেক আন্দোলন ও হাইকোটের নির্দেশ উপেক্ষা করে বহু গাছ নিধন করা হচ্ছে। এখন যুক্ত হয়েছে মানিকগঞ্জ-সিঙ্গাইর-হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের প্রায় ৪ হাজার গাছ। এভাবে গাছ কেটে নিধন করলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা চাই গাছগুলোকে আইল্যান্ডে রেখে মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা হোক। এতে করে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যও সংরক্ষিত হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবেশি দেশের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করা যেতে পারে।
 
সম্প্রতি প্রকাশিত এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্সে (ইপিআই) বাংলাদেশের হতাশাজনক চিত্র উঠে এসছে। দূষণ রোধে অগ্রগতি সূচকে তলানির দিক থেকে দ্বিতীয় হয়েছে বাংলাদেশ। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে উন্নয়ন ও পরিবেশকে সমান গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ  হচ্ছে বাংলাদেশ। পরিবেশ মানের সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২৯ দশমিক ৫৬। অবস্থান ১৭৯ নম্বরে। শুধুমাত্র বুরুন্ডির অবস্থান বাংলাদেশের নিচে। বাংলাদেশের উপরের  তিনটি দেশ হলো কঙ্গো (১৭৯), ভারত (১৭৭) ও নেপাল (১৭৬)। স্বল্প ইপিআই স্কোরের অর্থ হল এই দেশগুলোকে পরিবেশের মান উন্নয়নের বিভিন্ন দিক বিশেষ করে বাতাসের দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও গ্রিণ হাউজ গ্যাস নির্গমণ হ্রাসে আরো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইপিআই তৈরিতে বায়ুর মান, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন, পানিসম্পদ, ভারী ধাতুর উপস্থিতি, কৃষি, বনায়ন, জীববৈচিত্র্য, আবহাওয়া ও জ¦ালানির মতো ২৪ টি সূচককে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।  
 
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভ’মি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ সুতরাং যশোর-বেনাপোলের মতো মানিকগঞ্জ-সিঙ্গাইর-হেমায়েতপুর রাস্তার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। আঞ্চলিক মহাসড়কটির দুপাশের গাছগুলো অক্ষত রেখেই সম্প্রসারণ করা হলে তা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং জীব-বৈচিত্র্য, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।
 
আমরা রাস্তা সম্প্রসারণের নামে গাছ কাটার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং বিভিন্ন পেশাজীবি, পরিবেশবাদী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণকে পরিবেশ বিনষ্টকারী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানাচ্ছি। 
 
সুপারিশ
 
ক্স মানিকগঞ্জ-সিঙ্গাইর-হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক সম্প্রসারণ করার জন্য গাছ কাটা কার্যক্রম অনতিবিলম্বে বন্ধ করা। 
ক্স পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলায় মহাসড়কের দুই পাশের গাছগুলো রেখে মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা। 
ক্স হেমায়েতপুর সিঙ্গাইর মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের দুই পাশের গাছগুলো অক্ষত রেখে সড়ক ও জনপথ বিভাগ কর্তৃক মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ক্স সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সড়ক ও জনপথ বিভাগ কর্তৃক দীর্ঘ প্রায় ৬ মাসে মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ না করার কারণ চিহ্নিতকরণ এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ক্স পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী মানিকগঞ্জ-সিঙ্গাইর-হেমায়েতপুর আঞ্চলিক সড়ক-মহাসড়কের দুই পাশের গাছ কাটা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর ভূমিকা পালন করা।