ধুলা দূষণে নাকাল নগরবাসী-কর্তৃপক্ষ নির্বিকার ধুলা দূষণ বন্ধে চাই জরুরী পদক্ষেপ-দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা মহানগরীতে ধুলা দূষণের প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। এই মৌসুমে হাজার হাজার ইটের ভাটার পাশাপাশি মহানগরীতে সঠিক পরিকল্পনা ব্যতীত কোন সমন্বয় ছাড়াই গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং ফ্লাইওভার, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ইত্যাদি সেবামূলক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রাস্তা-ঘাট খোঁড়া-খুঁড়ির পরিমান বৃদ্ধি পায়। এসময় মাটি, বালিসহ এ ধরণের নানা সামগ্রী আচ্ছাদনহীন অবস্থায় ট্রাকে করে শহরে পরিবহন করা, ড্রেন পরিস্কার করে রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা, দোকান পাট ও গৃহস্থালীর আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, মেরামতহীন ভাংগাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, পাকা ভবন নির্মাণের সময় নিয়ম না মেনে মাটি, বালুসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী দীর্ঘদিন যত্রতত্র ফেলে রাখা, রাস্তার দু’পাশে ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা, ইট-পাথর মেশিনে ভাঙ্গা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ইত্যাদি ধুলা দূষণ সৃষ্টি করে। এরকম অসংখ্য উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ধূলা বাতাসে মিশে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে আমাদের নিঃশ্বাস। পরিসেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহ কর্তৃক অবকাঠামো তৈরি, সম্প্রসারণ ও মেরামত করার সময় খননকৃত মাটি ও অন্যান্য সামগ্রী রাস্তায় ফেলে না রেখে দ্রুত অপসারণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ দেখানো হলেও এ অর্থের সঠিক ব্যবহার দৃষ্টিগোচর হয় না। সুতরাং তহবিল ত¯্রুপের জন্য ঠিকাদার, দায়ী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আজ ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, সকাল ১১.০০টায় শাহাবাগস্থ চারুকলা অনুষদের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সহ ১৭ টি সংগঠনের উদ্যোগে ” ধুলা দূষণে নাকাল নগরবাসী-কর্তৃপক্ষ নির্বিকার; ধুলা দূষণ বন্ধে চাই জরুরী পদক্ষেপ-দায়ীদের শাস্তি” -দাবীতে আয়োজিত মানববন্ধনে নেতৃবৃন্দ উক্ত দাবী জানান। 
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, নাসফের সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী, পবা’র সহ-সম্পাদক স্থপতি শাহীন আজিজ, এম এ ওয়াহেদ, পুরান ঢাকা নাগরিক অধিকার উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, নোঙর-এর সভাপতি সুমন সামস্, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, ডাব্লিউবিবি-ট্রাস্ট এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক সৈয়দা অনন্যা রহমান, নগরবাসী সংগঠনের চেয়ারম্যান হাজী শেখ আনসার আলী, সচেতন নগরবাসীর সভাপতি জিএম রোস্তম খান, বিডি ক্লিক-এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, বানিপা’র সভাপতি প্রকৌ. মো: আনোয়ার হোসেন, নাসফের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম, ইয়ুথ সান-এর সমন্বয়ক আরিয়ান তানভীর, আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং প্রমুখ।
 
বক্তারা বলেন, বর্তমানে ধূলা দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধূলা দূষণে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ধূলাজনিত রোগব্যাধির প্রকোপ। রাস্তার পাশে দোকানের খাবার ধূলায় বিষাক্ত হচেছ প্রতিনিয়ত। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগ জীবাণুমিশ্রিত ধূলা ফুসফুসে প্রবেশ করে সর্দি, কাশি, ফুসফুস ক্যান্সার, ব্রংকাইটিস, শ্বাসজনিত কষ্ট, হাঁপানী, যক্ষ্মা, এলার্জি, চোখ জ্বালা, মাথা ব্যথা, বমি ভাব, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করছে। শিশু, বৃদ্ধ ও অশুস্থ ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় ধূলা দূষণের ফলে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য একটি মারাত্বক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ধূলার কারণে দোকানের জিনিসপত্র, কম্পিউটারসহ নানা ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ঘরবাড়ি আসবাবপত্রসহ কাপড় চোপড়ে ধূলা জমে যেভাবে প্রতিদিন নগর জীবনকে নোংরা করছে, তা পরিচ্ছন্ন রাখতেও নগরবাসীকে নষ্ট করতে হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা ও বিপুল পরিমাণ পানি এবং ডিটারজেন্ট। আর এসব পরিষ্কারক দ্রব্যের পরবর্তী গন্তব্য হচ্ছে নদী, লেক, জলাধারসমূহ। যা জলজ প্রাণীসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্রের জন্যও ক্ষতিকর। কাপড়-চোপড় ইস্ত্রি করতেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয়। অতিরিক্ত পানি, বিদ্যুৎ ও ডিটারজেন্ট ব্যবহারের ফলে পারিবারিকভাবে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ধূলা দূষণের কারণে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৪,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। ধুলা দূষণের কারণে বৃক্ষের সালোকসংশ্লেষণে বাধার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও ধুলা দূষণের ফলে মূল্যবান প্রতœতাত্বিক নিদর্শন, ইমারত, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন স্থাপনায় মরিচা পড়ে সেগুলোর আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিচ্ছে। এই সর্বগ্রাসী ধূলা দূষণে নগরবাসী অতিষ্ঠ, জনদূর্ভোগ চরমসীমায়। সুতরাং জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে ধুলা দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী। 
 
বক্তারা আরো বলেন, বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর গাবতলী হতে বাবু বাজার ব্রিজ পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সম্প্রসারণ কাজে সবচেয়ে বেশি ধূলিকণা ছড়িয়ে পড়ছে।  বেড়িবাঁধে চলাচলকারী জনসাধারণ ও যানবাহন, বাঁধের দুপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং এলাকার জনগণকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।  এর ফলে সর্দি, কাশি, হাঁপানি, এলার্জি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।  শিশু, গর্ভবতী মা, বৃদ্ধি ও অসুস্থ ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বেড়িবাঁধ সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (ই এম পি ) প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।  বেড়িবাঁধ সম্প্রসারণ কাজের ফলে সৃষ্ট ধুলা দূষণ নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর নিরব ভূমিকা পালন করছে।  যা জনগণের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
 
শহরের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে অচিরেই ধূলা দূষণের উৎসসমূহ বন্ধ করতে হবে। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের লাইনের খোঁড়াখুড়ির সময় যাতে ধূলা দূষণ না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। ভবন নির্মাণ এবং ভাঙ্গার সময় যথাযথ নিয়ম মেনে তা করতে হবে। ড্রেনের ময়লা এবং রাস্তা ঝাড়– দিয়ে ময়লা আবর্জনা জমিয়ে না রেখে সাথে সাথে অন্যত্র অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। গৃহস্থালী ও বাজারের ময়লা সঠিক নিয়মে দ্রুত সংগ্রহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ময়লা পরিবহণের গাড়িগুলোতে ভালোভাবে আচ্ছাদিত করে ময়লা পরিবহণ করতে হবে। ধূলা দূষণের সাথে জড়িত দায়ী ব্যাক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সর্বোপরি ধূলা দূষণের সকল উৎস বন্ধে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রয়োজনে লোকবল বৃদ্ধি ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনিটরিং বৃদ্ধি করতে হবে এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে ধূলাদূষণ নির্মূলে এলাকাভিত্তিক করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
 
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে ধুলা দূষণের কারণে শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে রোগীর প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগে ভর্তি হয়ে থাকে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরীর প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ ভয়াবহ ধুলা দূষণের শিকার হয়।
 
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বর্তমান সময়ে ঢাকা মহানগরীর একিউআই(এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক) তিনশতের উপরে। অনুমোদিত একিউআই ০-৫০ ভাল, ৫১-১০০ গড়ফবৎধঃব, ১০১-১৫০ ঈধঁঃরড়হ, ১৫১-২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর, ৩০১-৫০০ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। 
 
এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৯১টি দেশের ১৬০০ শহরের মধ্যে পরিবেষ্টক বায়ু দূষণের দিক থেকে সবচেয়ে দূষিত ২৫টি নগরীর মধ্যে বাংলাদেশের তিনটি নগরী (ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়নগঞ্জ) রয়েছে। নারায়নগঞ্জের অবস্থান ১৭তম, গাজীপুর ২১তম এবং ঢাকা ২৩তম। 
 
বাংলাদেশে ব্যবহৃত ডিজেল ও পেট্রোলে সালফারের পরিমাণ যথাক্রমে ৫০০০ ও ১০০০ পিপিএম। নেপাল, ভারত ও চীনে ৩৫০ ও ১৫০ পিপিএম। মোটরযান নিঃসরণ মানমাত্রা বাংলাদেশে ইউরো ১, নেপাল, ভারত ও চীনে ইউরো ৩।
ইউরো ১- কার্বণ মনোঅক্সাউড ২.৭২ জি/কেএম, হাইড্রোকার্বণ ও নক্স ০.৯৭ জি/কেএম. পিএম ০.১৪ জি/কেএম এবং ইউরো ৩- কার্বণ মনোঅক্সাউড ০.৬৪ জি/কেএম, হাইড্রোকার্বণ ও নক্স ০.৫৬ জি/কেএম. পিএম ০.০৫ জি/কেএম। উন্নত মানের জ্বালানী আমদানি ও ব্যবহারের মাধ্যমে বায়ু ও ধুলা দূষণ আংশিক রোধ করা সম্ভব।
 
বায়ু ও ধুলা দূষণের বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা ও চট্রগ্রাম মহানগরীসহ নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরকে বেইজিং, দিল্লী, তেহরান, প্যারিস-এর মতো ধূলা দূষণজনিত ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।
 
সুপারিশ
ক্স পরিসেবার অবকাঠামো তৈরি, সম্প্রসারণ ও মেরামত করার সময় খননকৃত মাটি ও অন্যান্য সামগ্রী রাস্তায় ফেলে না রেখে বিধি মোতাবেক দ্রুত অপসারণ করা। ব্যর্থ হলে এটি করার অর্থ ত¯্রুপের জন্য দূর্নীতি মামলা ও দায়ী কর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া;
ক্স পরিসেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সকল পরিসেবা কার্যক্রমের জন্য রাস্তা একবার খনন করা। পরিসেবার সম্প্রসারণ, সংযোগ, মেরামত ও নতুন সংযোগ স্থাপনের সময় রাস্তা খননকৃত মাটি সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা এবং দ্রুত রাস্তা মেরামত করা;
ক্স রাস্তাঘাট ও ফুটপাত নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করা;
ক্স ভবন নির্মাণ ও মেরামত বা অন্য যে কোন অবকাঠামো নির্মাণের সময় নির্মাণ সামগ্রী রাস্তার উপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় না রাখা;
ক্স ধূলা সৃষ্টি করে এমন কোন সামগ্রী (বালু, মাটি, ইট, পাথর) বহনের সময় সঠিক আচ্ছাদন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া;
ক্স সকল আবর্জনা যথাযথ স্থানে ফেলা, সিটি করপোরেশন কর্তৃক আবর্জনা সংগ্রহ ও পরিবহনের সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে যানবাহন থেকে আর্বজনা রাস্তায় ছড়িয়ে না পড়ে; 
ক্স ধুলা দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনসমূহ বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে তাদের উপর অর্পিত আইনানুগ দায়িত্ব আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতার সাথে পালন করা;