“দখল-দূষণ রোধ করে শীতলক্ষ্যা বাঁচাও”
শিল্প কারখানার বেপরোয়া দখল, দূষণ ও ভরাটের ফলে শীতলক্ষ্যা নদীর অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখিন। কারখানাগুলোতে শিল্প বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি স্থাপন করলেও অনেকে তা সার্বক্ষণিক চালু রাখছে না। ফলে দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। দখল-দূষণ, ভরাট রোধ করে শীতলক্ষ্যা বাঁচাতে হলে অবিলম্বে নদী তীরবর্তী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও কারখানায় সার্বক্ষণিক ইটিপি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। আজ ০৩ মার্চ ২০১৮, শনিবার, সকাল ১১.০০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সহ ১৭ টি সংগঠনের উদ্যোগে “দখল-দূষণ রোধ করে শীতলক্ষ্যা বাঁচাও; অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও কারখানায় ইটিপি বাধ্যতামূলক কর” -দাবীতে আয়োজিত মানববন্ধনে নেতৃবৃন্দ উক্ত দাবী জানান। 
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, বাঁচাও শীতলক্ষ্যা নদী আন্দোলনের আহ্বায়ক বোরহান মেহেদী, পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ, পুরান ঢাকা নাগরিক অধিকার উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ-এর সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, সুবন্ধন সমাজ কল্যাণ সংসদ-এর সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান, বাঁচাও শীতলক্ষ্যা নদী আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহ্বুব সৈয়দ, ডাব্লিউবিবি-ট্রাস্ট-এর কর্মসূচী ব্যবস্থাপক সৈয়দা অনন্যা রহমান, সচেতন নগরবাসীর সভাপতি জিএম রোস্তম খান, নগরবাসী সংগঠনের চেয়ারম্যান হাজী শেখ আনসার আলী, সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর হিরু, ইয়ুথ সান-এর সমন্বয়ক শিকদার আরিয়ান তানভীর প্রমুখ।
 
পবা’র চেয়ারম্যান ও মানববন্ধনের সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, বিভিন্ন কলকারখানায় উৎপাদিত বিষাক্ত বর্জ্য, টেক্সটাইল মিলের রাসায়নিক বর্জ্যসহ অন্যান্য বর্জ্য সরাসরি নদীতে না ফেলে ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধন করতে হবে এবং ইটিপি সর্বক্ষণ চালু রাখতে হবে। এছাড়াও নরসিংদীর পলাশসহ শীতলক্ষ্যার দু’পাড়ের অবৈধ সকল স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে।
 
বাঁচাও শীতলক্ষ্যা নদী আন্দোলন-এর আহ্বায়ক বোরহান মেহেদী বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীতে বালু তুলে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা রাতারাতি অসম নদী ড্রেজিং করার ফলে পাশর্^বর্তী গ্রামসমূহ ভাঙনের কবলে পড়েছে। তাছাড়া নদীর তীর কেটে নির্বিচারে বালুদস্যুতার ফলে ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
 
অন্যান্য বক্তারা বলেন, শিল্প বাণিজ্য বিকাশে নদীর রয়েছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিশে^র তাবৎ বড় বড় নগর ও শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। কেননা শিল্প কারখানার কাঁচামাল পরিবহন আর উৎপাদিত পণ্য বিপণনে সহজতর ব্যবস্থা নদী সূত্রেই মেলে। শিল্প কারখানার পানির চাহিদা নদী থেকেই মেটানো হয়। শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থায় নানা উপায়ে উপকরণ হিসাবে নদীকে ব্যবহার করা হয়। পরিবেশ দূষণের বহুবিধ সমস্যা নিরসন নদীর পানি দিয়েই করা হয়। বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের কথা আমাদের সবারই জানা। মোগল শাসন আমল এমনকি ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়ও শীতলক্ষ্যার পানি দ্বারা মসলিন কাপড়ের সুতা তৈরী হতো। নদীর পানির এক বিশেষ ধরনের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য এর একমাত্র কারণ। 
 
শীতলক্ষ্যার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষত্ব। শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের সোনার জমিগুলি ছিল সবুজ ফসলে ভরা। নদীতে ছিল প্রচুর প্রজাতির মাছ। আজ তা অতীত গল্প মাত্র। বাস্তব হচ্ছে কল্লোলিনী শীতলক্ষ্যা এখন আর বহমান নয়। আমৃত্যু লালিত শীতলক্ষ্যা হারিয়েছে তার সতীত্ব। একদল লুটেরা লুট করে নিয়েছে শীতলক্ষ্যার যৌবন। শীতলক্ষ্যা এখন স্থবির, জীর্ণ ও অসহায়। নদীপথ যোগাযোগ ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবন উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা ছিল। এই নদীর তীর ঘেষে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা। এসব প্রতিষ্ঠান গুলি ধীরে ধীরে নদীর জমি ভরাট করে দখল করে ফেলেছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের দখল ও দূষণের ফলে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এই নদীটি। মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। বেকার হয়ে পড়েছে শতশত জেলে পরিবার। নরসিংদী পলাশের অংশের পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে সেভেন রিংস সিমেন্ট, তাওহদী সিমেন্ট, কাজী সিমেন্ট, সেমরী ডাইং, ফৌজী চটকল মিল, প্রাণ আরএফএল গ্রুপ, ক্যাপিটাল পেপার মিল, জনতা জুট মিল, দেশ বন্ধু সুগার মিলসহ অসংখ্য ছোট বড় শিল্প কারখানা। আর এসব শিল্প কারখানাগুলির বর্জ্যও সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। কোম্পানিগুলি ব্যক্তি মালিকানা কৃষি জমি ক্রয় করে এবং পরবর্তীতে বর্জ্য, বালি ও মাটি ফেলে ভরাট করে কারখানার সীমানা বৃদ্ধি করেছে ও করছে।
 
ইতোমধ্যে  মধ্যার ঘাট, ভূঁইয়ার ঘাট, নাথ ঘাট, দাসপাড়া ঘাট, চরপাড়া ঘাট, বাইদ্যা ঘাট, ডাক বাংলা ঘাট, শ্মশান ঘাট, জামালপুর ঘাটসহ নদীটির পলাশের অংশে নদীর অর্ধেক অংশ দখল করে আছে ভূমি দস্যুরা। প্রথমে ব্যক্তি মালিকানা অল্পজমি কিনে পরবর্তীতে বর্জ্য ও বালি দিয়ে ধীরে ধীরে নদীটির ব্যাপক অংশ দখল করে নেয়। ২২৮ মিটার প্রস্থ নদীটির ২০০ মিটার দখল করে নিয়েছে। এমনকি প্রাণ গ্রুপ সরকারের কাজ থেকে গো-খাদ্যের কথা বলে ঘোড়াশালের বাঘপাড়ায় দুই বিঘা জমি লিজ নিয়ে সেখানে গড়ে তুলেছেন বহুতল স্থায়ী ভবন। অন্যদিকে শান্তানপাড়া নদীর পাড়ে অবস্থিত ক্যাপিটাল পেপার মিল লিমিটেড থেকে পাইপযোগে লাল রংয়ের বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হচ্ছে। কারখানাটিতে প্রায় প্রতিদিন ১২০ টন কাগজ উৎপাদিত হয়। আর প্রতিটন কাগজ তৈরীতে ন্যূনতম ২৫ টন পানি ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে প্রতিদিন ৩০ টন পানি (বর্জ্য) শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হয়।
 
প্রতিষ্ঠানগুলোর ইটিপি থাকলেও বেশির ভাগ সময় বন্ধ রাখা হচ্ছে। আমাদের কর্মকান্ড, উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা, নিষ্ক্রিয়তাই শান্ত-¯িœগ্ধ-স্বচ্ছ জলধারায় জোয়ার ভাটা প্রভাহিত শীতলক্ষ্যাসহ শত নদ নদী প্রবাহকে দারুনভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। দিন দিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নদী। ঐতিহ্য তলানিতে এসে মিশেছে। আমাদের চেতনার জাগরণ ঘটেনি। আমাদের বিদ্যাচর্চার নদীও পরিবেশ সংরক্ষণে শাণিত নয়। হাজার নদীর ঐতিহ্যমন্ডিত দেশে আমরা পানি হাহাকারের দিকে ধাববান। পানি সংকট আমাদের গ্রাস করতে তেড়ে আসছে। পৃথিবীর বহুদেশে নদীবেষ্টিত শহরগুলোর নদী দূষণের ফলে নদী ও মানুষের ওপর মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আবার অনেক শহর নদী কেন্দ্রীক হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিনোদনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর বড়-বড় দেশগুলো গড়ে উঠেছে মূলত বিখ্যাত নদীগুলোকে ঘিরে। তাই এখনই সরকারকে শীতলক্ষ্যাসহ দেশের সকল নদী রক্ষার্থে যত দ্রুত সম্ভব বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
 
 
সুপারিশসমূহ:
১. নদীর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। ময়লা-আবর্জনা ও রাসায়নিক বর্জ্যরে দূষণ থেকে নদীটিকে রক্ষায় মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
২. নদী তীরবর্তী কারখানাগুলোকে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে ও সবসময় চালু রাখতে হবে।
৩. পলাশ ও কালিগঞ্জ অংশসহ শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে সিএস রেকর্ড অনুযায়ী সীমানা পিলার স্থাপন করতে হবে।
৪. নরসিংদীর পলাশসহ শীতলক্ষ্যার সর্বত্র সবধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার পাশাপাশি দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 
৫. গৃহস্থালির বর্জ্যসহ কোনো বর্জ্য যাতে নদীতে ও এর তীরবর্তী স্থানে না ফেলা হয় সে ব্যাপারে সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব নিতে হবে।