৭ বছরেও পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানা গুদাম সরেনি সরকারী সংস্থার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার অভাব
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক পদার্থের গুদামে বিস্ফোরণে সংগঠিত  ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১২৪ জন মারা যান। দুর্ঘটনার পর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৈধ ও অবৈধ কারখানাগুলো সরাতে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও ৭ বছরে নিমতলীর আশেপাশের এলাকা এবং পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা সরিয়ে নেয়ার দৃশ্যমান কোন কার্যত্রম পরিলক্ষিত হয়নি। সরকারী সংস্থার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার অভাবেই এর প্রধান কারণ বলে মানববন্ধনে বক্তারা  অভিমত ব্যক্ত করেন। বক্তারা পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা ও দোকান সরিয়ে নেয়ার দাবী জানান। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ ২১টি পরিবেশবাদী ও সমমনা সংগঠনের উদ্যোগে আজ ০৩ জুন ২০১৭, শনিবার, সকাল ১০.৩০ টায় নিমতলী ছাতা মসজিদের সামনে “পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম , কারখানা ও দোকান  সরিয়ে নেয়া হোক”-দাবীতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। 
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে এবং পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন সাবেক এমপি ও বিএমএ-এর সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ৩৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী মো. আউয়াল, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, পবা’র সহ-সম্পাদক মো. সেলিম, সুবন্ধন সমাজ কল্যাণ সংগঠনের সভাপতি হাবিবুর রহমান, বিসিএইচআরডি-এর সভাপতি মাহবুব হক,  বিডিক্লিক-এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, পবা’র সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদের সভাপতি মো. মুসা, নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি হাজী আনসার আলী, পুষ্প সাহা পুকুর রক্ষা কমিটির সভাপতি নাসির খান মিন্টু, মাস্তুলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মার্জান, বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের সভাপতি ইঞ্জি. মো. আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান বলেন, পুরান ঢাকা ঐতিহ্যবাহী ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে একই ভবনে রয়েছে রাসায়নিক কারখানা,  গুদাম ও দোকান, বাসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণ সংঘঠিত অগ্নিকান্ডে ১২৪ জন মারা যান এবং অনেকে আহত হন। দূর্ঘটনার পরপরই সরকারীভাবে বিভিন্ন কমিটি করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গঠিত কমিটি পুরান ঢাকাসহ ঢাকার সকল রাসায়নিক কারখানা গুদাম ও দোকানের জন্য অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত একটি এলাকা গড়ে তোলার সুপারিশ করে। দীর্ঘ ৭ বছর পার হলেও তৎকালিন কমিটির সুপারিশ আজও আলোর মুখ দেখেনি। যেকোন দূর্ঘটনার পরপরই সরকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্মতৎপরতা দেখা যায়। পরবর্তীতে তা ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পরে। সরকারি সংস্থার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার অভাবই এর প্রধান কারণ।
তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরীতে এক হাজারের বেশি রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম রয়েছে। যার প্রায় ৮৫০টি পুরান ঢাকায়। এসব কারখানা গুদাম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসন। এসব সংস্থাকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে আমরা দেখছি না। রাসায়নিক কারখানা, গুদামের জন্য সরকার একটি সুনির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা গড়ে তোলা এবং এসব প্রতিষ্ঠান পুরান ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিদ্যমান আইনগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কঠোরভাবে প্রয়োগ করা।
তিনি আরও বলেন, একটি আদর্শ নগরীর জন্য ২৫% খোলা জায়গা প্রয়োজন। ঢাকা মহানগরীতে ২০% খোলা জায়গা রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে পুরান ঢাকায় ৫% আর নতুন ঢাকায় ১২% খোলা জায়গা রয়েছে। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড়স্থ কেন্দ্রীয় কারাগারের ভ’মির পরিমাণ ৪০ একরের বেশি। কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় অবস্থিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান কারা স্মৃতি যাদুঘর ও জাতীয় চার নেতার কারা স্মৃতি যাদুঘর দুটি সংরক্ষণসহ পার্ক, জলাধার, খেলার মাঠ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে একবিংশ শতাব্দির উপযোগী ‘সবুজ বলয়’ গড়ে তোলা প্রয়োজন। যা পুরান ঢাকাসহ ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। একই সাথে নগরবাসীর জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাবে, সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করবে এবং সামাজিক অস্থিরতা দূরীকরণে সহায়ক ভ’মিকা পালন করবে।
 
বক্তারা বলেন, পুরান ঢাকার রয়েছে গৌরবোজ্জল এক ইতিহাস। কালের বিবর্তনে আজ তা হারিয়েছে যাচ্ছে। ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকাবাসী বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রাপ্য নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। একদিকে প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা-ঘাট, নালা-নর্দমা, উম্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, পার্ক, মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা। অন্যদিকে পুরা এলাকা একটি মিশ্র এলাকা হিসাবে গড়ে উঠেছে। যেখানে একই সঙ্গে অবস্থান করছে আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, শিল্পকারখানা, কেমিক্যালের গুদাম, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া একই ভবনে রয়েছে শিল্পকারখানা, রাসায়নিক  দাহ্য পদার্থসহ বিভিন্নমালামালের গুদাম ও দোকান, বাণিজ্যিক কর্মকান্ড এবং আবাসিক ফ্ল্যাট।
 
রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের ব্যবস্থাপনায় সামান্য ত্রুটির কারণে ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে একটি ভবনের নিচতলার রাসায়নিক  দাহ্য পদার্থের গুদামে আগুন লেগে মুহূর্তেই তা বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। রাসায়নিক কারখানা, গুদাম, দোকানে আগুন নিভানোর নিজস্ব কোন ব্যবস্থা নেই। এলাকায় প্রয়োজনীয় রাস্তার অভাবে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ীগুলো দুর্ঘটনাস্থলে পৌছাতে পারে না। অনেক সময় অগ্নিকান্ডস্থলের কাছে জলাধার না থাকায় পানির অভাবে ফায়ার সার্ভিসকে বেগ পেতে হয়।
 
জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা, সিটি করপোরেশন -এর উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতা এবং ভবনের মালিক ও রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের ব্যবসায়ীদের আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হওয়া ও অসচেতনার কারণে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকান্ডসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার পর পর সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা লোকদেখানো বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৈধ ও অবৈধ কারখানাগুলো সরাতে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও  গত সাত বছরে নিমতলীর আশেপাশের এলাকা এবং পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা, দোকানগুলো সরিয়ে নেয়ার বাস্তসম্মত দৃশ্যমান কোন কার্যত্রম পরিলক্ষিত হয়নি। বরং অলিতে-গলিতে গড়ে উঠছে রাসায়নিকের গুদাম, কারখানা ও দোকান এবং প্লাস্টিক ও পলিথিন কারখানা। নিমতলী এখনো একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। 
 
ঢাকা মহানগরীতে এক হাজারেরও বেশী কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম রয়েছে। এর মধ্যে আট শত পঞ্চাশেরও বেশী অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র বা লাইসেন্স গ্রহণের বিধান রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম পরিচালনার কোন সুযোগ নেই।
 
আবাসিক এলাকা থেকে  বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, শিল্পকারখানা ও দোকান সরিয়ে নেয়া না হলে নিমতলীর মতো আবারও যেকোন সময় বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। পুরান ঢাকায় বিদ্যমান  বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, শিল্পকারখানা ও দোকানগুলো ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকার জনজীবন, জননিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।  তাই জরুরীভিত্তিতে পুরান ঢাকাসহ  রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা ও দোকান সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন।
 
করণীয়ঃ
১. ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা ও দোকান সরিয়ে নেয়া।
২. রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা ও দোকানের জন্য একটি পরিকল্পিত এলাকা গড়ে তোলা, যেখানে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে ।
৩. পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক আবাসিক এলাকায় পরিচালিত রাসায়নিক কারখানা, গুদাম- এর বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।।
৪. রাসায়নিক কারখানা, গুদাম ও দোকান পরিচালনার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন কর্তৃক সংশ্লিষ্ট আইন মোতাবেক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৫. পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা, গুদাম সরাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা।
৬. নিমতলী অগ্নিকান্ডে নিহতদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা।
৭. প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সংগৃহীত অর্থ ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে সুষ্ঠু বন্টনের ব্যবস্থা করা।
৮. পুরান ঢাকাসহ ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় অবস্থিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান কারা স্মৃতি যাদুঘর ও জাতীয় চার নেতার কারা স্মৃতি যাদুঘর দুটি সংরক্ষণসহ পার্ক, জলাধার, খেলার মাঠ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে একবিংশ শতাব্দির উপযোগী ‘সবুজ বলয়’ গড়ে তোলা।