ইফতারিসহ সকল খাদ্য বিষ ও ভেজালমুক্ত চাই
পবিত্র রমজান মাসের প্রায় অর্ধেক সময় অতিক্রান্ত হলো। প্রতিবছরই আমরা দেখতে পাই রমজানে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর রেল ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, মোটর যান, নৌ যান ও কলকারখানার পোড়া তেল ও মবিল মিশ্রিত তেল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ইফতার সামগ্রী ভাজা হয়। এছাড়াও একই তেল বার বার ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক রং ও বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে ভোজ্য তেল তৈরী করা হয়। বিষাক্ত রং ব্যবহার করে সাদা ডিম লাল করা হয় । এছাড়াও পঁচা-বাসীসহ বিভিন্নভাবে ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যের ব্যপকতা বেড়ে যায়। এতে ক্যান্সার, কিডনী ও লিভারের জটিল রোগ সৃষ্টিসহ গর্ভস্থ শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমতাবস্থায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ ১৮টি পরিবেশবাদী ও সমমনা সংগঠনের উদ্যোগে আজ ১০ জুন ২০১৭, শনিবার, সকাল ১১.০০টায় বেইলী রোডস্থ বেইলী স্টারের সামনে “ইফতারিসহ সকল খাদ্য বিষ ও ভেজালমুক্ত চাই”- দাবীতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
 
নাসফ-এর সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়না’র সভাপতিত্বে এবং পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, সুবন্ধন সমাজ কল্যাণ সংগঠনের সভাপতি হাবিবুর রহমান, পবা’র সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, বিসিএইচআরডি-এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হক, পবা’র সহ-সম্পাদক নিশাত মাহমুদ, নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি হাজী শেখ আনসার আলী, পবা’র সদস্য অমূল্য কুমার বৈদ্য, ইয়ুথ সান-এর সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পি, সূচনা নারী উন্নয়ন সংস্থা-এর নির্বাহী পরিচালক শাহানা হক প্রমুখ।
 
নাসফ-এর সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়না তার বক্তব্যে বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিষ ও ভেজালমুক্ত এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্রকে আমরা এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে দেখছি না। আর আমরা বঞ্চিত হচ্ছি বিষ ও ভোজালমুক্ত খাদ্য পাওয়ার অধিকার থেকে। এখন এমন কোন খাদ্যদ্রব্য নেই যাতে ফরমালিনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল নামের নীরব ঘাতক বিষ মিশানো হয় না। উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ প্রত্যেকটি স্তরেই এর ছড়াছড়ি রয়েছে। সহজপ্রাপ্যতা, আইন প্রয়োগ ও যথাযথ নজরদারির অভাবে এসব ঘটেই চলেছে। এখন প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধনপূর্বক সমন্বিত বাস্তবসম্মত মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা এবং জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্যে বিষ বা ভেজাল রোধে কোন রকম বৈষম্য বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান বক্তব্যে বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪, ভোক্তা অধিকার আইন, নিরাপদ খাদ্য আইন, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৫-এসকল আইনে কঠোরভাবে বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্যের কথা উল্লেখ আছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিষ ও ভেজাল প্রয়োগের জন্য মৃত্যুদন্ড প্রদানের বিধান আছে। বিদ্যমান আইনগুলোর বাস্তবায়নে নিয়োজিত সংস্থাগুলো তাদের উপর অর্পিত আইনসিদ্ধ দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে দেখা যায়। কিন্তু তা সমস্যার ভয়াবহতার তুলনায় অতি নগন্য এবং খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশের সব আইনেই খাদ্যে ফরমালিন মিশানো নিষিদ্ধ। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য আইন কর্তৃপক্ষ তাদের প্রচারিত গণবিজ্ঞপ্তিতে ফরমালিনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা প্রচার করে থাকে। যা আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকেও তাদের আইনসিদ্ধ দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। সরকারের কাছে পবা’র আহবান এই যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সংস্থা গুলো বিদ্যমান আইন সমূহ যাতে যথাযথভাবে কার্যকর বা বাস্তবায়নে তৎপর হোন। এ সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার জন্য মূলত জবাবদিহিতার অভাব ও দায়িত্বের অবহেলাকেই দায়ি করা যায়। 
 
অন্যান্য বক্তারা বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিষ ও ভেজালমুক্ত এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্রকে আমরা এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে দেখছি না। আর আমরা বঞ্চিত হচ্ছি বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য পাওয়ার অধিকার থেকে। এখন এমন কোন খাদ্যদ্রব্য নেই যাতে ফরমালিনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল নামের নীরব ঘাতক বিষ মিশানো হয় না। উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ প্রত্যেকটি স্তরেই এর ছড়াছড়ি রয়েছে। সহজপ্রাপ্যতা, আইন প্রয়োগ ও যথাযথ নজরদারির অভাবে এসব ঘটেই চলেছে।
 
রমজান মাসে ইফতারিতে যেসব খাদ্যপণ্যের সবচেয়ে বেশী চাহিদা সেগুলো হলো শরবত, খেজুর, ছোলা, মুড়ি, বেসন, ডাল, তেল, চিনি, দুধ, সেমাই, মুরগী, মাছ, দেশী-বিদেশী ফল, শসা, টমেটো, বেগুন, কাঁচা মরিচ, লেবু, আটা, ময়দা, ইত্যাদি। রমজানের বাজার ধরার লক্ষ্যে এসব খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও মজুত করতে বিষাক্ত কেমিক্যাল, অৎঃরভরপধষ ঐড়ৎসড়হব এৎড়ঃিয, ফরমালিন ও মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর রেল ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, মোটর যান, নৌ যান ও কলকারখানার পোড়া তেল ও মবিল মিশ্রিত তেল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ইফতার সামগ্রী ভাজা হয়। এছাড়াও একই তেল বার বার ব্যবহার করার ফলে তা বিষাক্ত হয়ে যায়। রাসায়নিক রং ও বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে ভোজ্য তেল তৈরী করা হয়। খেজুরে মিশানো হচ্ছে ফরমালিন। এছাড়াও পঁচা-বাসীসহ বিভিন্নভাবে ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যের ব্যাপকতা বেড়ে যায়। এসব খাবার ক্যান্সার, কিডনী ও লিভারের জটিল রোগ সৃষ্টিসহ গর্ভস্থ শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
 
বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহতা বিবেচনায় বর্তমান সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৫, নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। এছাড়াও রয়েছে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ১৯৭৪। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় সংসদ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার যথাযথ উদ্যোগ ও অঙ্গীকারের অভাব, বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনুধাবনে ব্যর্থতার ফলে আমরা জনগণ এর কোন সুফল পাচ্ছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ধীরে ধীরে আমরা পঙ্গু জাতিতে পরিণত হব। 
 
 
করণীয়-
ক্স নিজের ও সšতানেরসহ সকল শিশু ও মা এবং জনগণের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সর্ব¯তরের ব্যবসায়ীদেরকে ইফতারিসহ সকল খাদ্যে বিষ ও ভেজাল মিশানো থেকে বিরত থাকা।
ক্স খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি মিশানোর সাথে জড়িত ও রাসায়নিক দ্রব্যাদিযুক্ত খাদ্য বিক্রয়কারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ড প্রদানই যথেষ্ট নয়।  এদের বিরুদ্ধে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ১৯৭৪ এর ২৫-গ ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই আইনের ২৫-গ ধারায় খাদ্যে ভেজাল দেয়ার জন্য কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ বা ভেজাল খাবার বিক্রয়ের জন্য মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।
ক্স ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদ কর্তৃক নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়। আইনের আওতায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হলেও অদ্যাবধি কর্তৃপক্ষের বাস্তব কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আইনটি বাস্তবায়নে জরুরীভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ক্স ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৫ দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
ক্স ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
ক্স জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্যে বিষ বা ভেজাল রোধে কোন রকম বৈষম্য বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ক্স দেশের চাহিদা অনুযায়ী টিসিবির মাধ্যমে ফরমালিন আমাদানি করা।
ক্স ভেজাল বিরোধী টিম কর্তৃক নিয়মিতভাবে খেজুরসহ অন্যান্য ফল, মুড়ি, সেমাই, রং মিশ্রিত সকল খাবার, ইত্যাদি পরীক্ষা করা এবং সকল খাদ্য মজুদকারী গুদাম/কারখানা /মোকাম পরিদর্শন করা। 
ক্স পণ্য আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক ফরমালিনসহ অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদি পরীক্ষা করা এবং এ কাজে এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
ক্স বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারকে খাদ্যে বিষ মিশ্রণের উৎসমূল থেকে শুরু করে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
ক্স সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থের আমদানিকারক ও ব্যবহারকারী এবং লেবেল ছাড়া বা মিথ্যা লেবেলের অধীন কীটনাশক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ক্স গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদির বিষয়ে সচেতন করা।