জলাবদ্ধতা বাণিজ্য বন্ধ কর জলাবদ্ধতা নিরসনে চাই সামগ্রিক ও বহুমাত্রিক কার্যকর পদক্ষেপ
এক সময় ঢাকা মহানগরীর সকল নিচু এলাকা খাল বিল নদী নালা মাছ ধরার জালের মতো আন্তঃসংযোগ ছিল। তখন কোন জলাবদ্ধতা ছিল না। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে বন্যা হত। প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম বিবেচনা না করেই আমরা উন্নয়নের জন্য অধিকাংশ নিচু এলাকা খাল বিল সমূহ ভরাট করে ফেলেছি। ফলে প্রাকৃতিক ভাবে স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলেছি। লক্ষ কোটি টাকা দিয়েও সেই সুন্দর প্রাকৃতিক নিস্কাশন ব্যবস্থা বিকল্প তৈরি সম্ভব নয়। তাছাড়া খাল বিল সমূহ পানি নিষ্কাশন ছাড়াও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে আমাদের জীবন মান বজায় রাখার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য খেসারত হিসেবে আমাদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। এমতাবস্থায় জনদূর্ভোগ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ ১৭টি পরিবেশবাদী ও সমমনা সংগঠনের উদ্যোগে আজ ১৫ জুলাই ২০১৭, শনিবার, সকাল ১১টায় মৌচাক মার্কেটের বিপরীত পাশে (ফর্চুন শপিংমলের সামনে) “জলাবদ্ধতা বাণিজ্য বন্ধ কর-জলাবদ্ধতা নিরসনে চাই সামগ্রিক ও বহুমাত্রিক কার্যকর পদক্ষেপ”- দাবীতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে এবং পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান, নাসফের সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়না, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, পল্লীমা গ্রীণের সদস্য সচিব আনিসুল হোসেন তারেক, পবা’র সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, পবা’র সহ-সম্পাদক নিশাত মাহমুদ, ইয়ুথ সান-এর সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পি, বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন-এর সভাপতি প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন, ডাব্লিউবিবি-ট্রাস্টের প্রকল্প কর্মকর্তা আতিকুর রহমান, ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতি’র সাংগঠনিক সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, পবা’র সদস্য মো. মুসা, এস আই চৌধুরী, এবিএম এনামুল হক, কায়সার আহমেদ, সুজন-এর সদস্য কানিজ ফাতেমা, কবি বাঙ্গাল আবু সাঈদ স্মৃতি সংসদ-এর সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সাঈদ আলাল প্রমুখ।
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বক্তব্যে বলেন, বর্তমান ড্রেনেজ ব্যবস্থায় ঘন্টায় ১০-২০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত পরবর্তী পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে। ঢাকা শহরের ২৯০ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং ১০টি কালভার্ট রয়েছে পানি নিষ্কাশনের জন্য। বর্তমান সিটি করপোরেশন সম্ভাব্য এলাকায় দৈনিক প্রায় ৮০০০ টন মিউনিসিপল বর্জ্য উৎপাদিত হলেও অপসারণ করা হয় মাত্র ৫০০০ টন এবং বাকি ৩০০০ টন বিভিন্ন ড্রেন, খাল বিলে জমে পানি নিষ্কাশনে বাধার সৃষ্টি করছে। গত ১১ জুলাই ২০১৭ তারিখে ২৪ ঘন্টায় ১০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে যা পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। এর মূল কারণ অপরিষ্কার ড্রেন এবং ২৫০টি পাম্পের ৯৬টি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। 
 
প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধ্বংস করে যে বর্তমান ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল ও অপরিকল্পিত এবং ভারসাম্যহীন। ফলে দূর্নীতি না হলেও অনেক বেশি খরচ করে কম পানি নিস্কাশন হয়। যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা আছে তাও কার্যকর নয়। কারণ –(১) বর্তমানে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার রাস্তায় খুড়াখুড়ি (২) ড্রেনেজের মুখে ময়লা থাকায় কিংবা পলিথিনসহ নানাবিদ কারণে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। (৩) ড্রেনসমূহকে যথাযথভাবে পরিষ্কার রাখা হয় না।
 
এছাড়াও মহানগরী সমূহতে জলাবদ্ধতা ও পানি নিষ্কাশনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়-
(১) জঙ্গল ও বড়বড় গাছ নিধন- জঙ্গল ও বড় বড় গাছ বৃষ্টির পানির একটি অংশ ধরে রাখে এবং ভূগর্ভস্থ স্তরে পানি পুনঃর্ভরণ বেশি হয় এবং বৃষ্টির পানি গড়িয়ে অন্যত্র যাওয়া প্রলম্বিত করে। গাছ নিধনের ফলে জলাবদ্ধতার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(২) বৃষ্টির পানি ভূগর্ভস্থ হওয়া- ঢাকা শহরের অধিকাংশ জায়গা সান বাঁধাই হয়ে যাচ্ছে এবং নিচু জায়গা ভরাট হয়ে যাচ্ছে।  ফলে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভস্থ হওয়ার জায়গা ও সুযোগ অনেক কমে যাচ্ছে। ফলে জলাবদ্ধতা বাড়ছে অন্য দিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমান্বয়ে বেশি করে নিচে চলে যাচ্ছে।
(৩) জনঘনত্ব-বিল্ডিং-এ বসবাসরত প্রতিটি মানুষ গড়ে ১০০ লিটার পানি ব্যবহার করে। এই পরিমাণ পানি নিষ্কাশন হয় ড্রেনেজের মাধ্যমে।  জনঘনত্ব অসম ও অপরিকল্পিতভাবে বাড়ছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থায় জনঘনত্বের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পায় না। ফলে ড্রেনেজ ব্যবস্থায় অসমভাবে চাপ সৃষ্টি হয়।
(৪) বিল্ডিং ও কনস্ট্রাকশন- যথাযথ নিয়ম না মেনে ইমারত নির্মাণ বা কনস্ট্রাকশন কাজ করার ফলে এসমস্ত তৈরিতে দ্রব্যাদির একটি অংশ নিকটস্থ ড্রেনেজ ব্যবস্থাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। ফলে স্থানীয়ভাবে জলাবদ্ধতার প্রকোপ বৃদ্ধি পায় তাছাড়া রাস্তা বা আশেপাশে ময়লা ভালোভাবে পরিস্কার রাখা হয় না এমনকি অনেক সময় ময়লা ড্রেনে বা ড্রেনের মুখে রাখা হয়। ফলে ড্রেনেজ সিস্টেম অকার্য্যকর হয়ে পড়ে।
(৫) নি¤œমানের কনস্ট্রাকশনের কাজ-ড্রেনের কাজের নি¤œমান, ভূগর্ভস্থ বিভিন্ন সেবা সমূহের নি¤œমানের অবকাঠামো তৈরি, রাস্তা মেরামত ও তৈরির নি¤œমানের কারণে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংকোচিত হয় ও আয়ুস্কাল কমে যায়।
(৬) বক্সকালভার্ড-  বক্সকালভার্ড দ্রুত ভরাট হয়ে যায়, পরিস্কার করা খুব কঠিন হয় ফলে পানিনিষ্কাশনে তা কাজে আসে না।
 
জলাবদ্ধতা কমাতে বা নিরসন করতে উপরোক্ত বিষয়সহ অন্যান্য যে সমস্ত বিষয় ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে সে সমূহকে যথাযথভাবে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। জলাবদ্ধতার কারণ ও তা নিরসনে সামগ্রিক দিক বিবেচনা না করে বরং একে পুজি করে ব্যয়বহুল অনেক প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গত ১০ বছরে ওয়াসা ১০০০ কোটি টাকা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সংস্কারের কাজে ব্যয় করে ও গত ৫ বছরে সিটি করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষ প্রায় ১০০০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ হলেও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজের প্রতি তারা খুবই উদাসিন বরং চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাজের সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
 
জলাবদ্ধতা কমাতে/ নিরসনে সুপারিশ সমূহ:
(১) ওয়াসা এবং সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমূহ ব্যয়বহুল প্রকল্পের আসক্তি এবং দায়িত্বহীন আচরণ থেকে বিরত থেকে তাদের সামগ্রিক কাজের দ্বায়ভার বহন করতে হবে। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাজের সমন্বয় সাধন করতে হবে।
(২) অবিলম্বে “পেইড বিশেষজ্ঞ ও সিভিল সোসাইটির সদস্য” ছাড়াও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমূহের সাথে ধারাবাহিকভাবে অর্থবহ আলোচনা ও পর্যালোচনার কাঠামো তৈরি করা। এই কাঠামোর তত্ত্বাবধানে সামগ্রিক বিষয়সমূহ বিবেচনা করে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করে সময় ভিত্তিক একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
(৩) সর্বনি¤œ খরচে এবং অবকাঠামোর পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে ভূগর্ভস্থ বিভিন্ন অবকাঠামোর একটি ত্রিমাত্রিক জরিপ করা। জরিপের পর ত্রিমাত্রিক একটি অবকাঠামো মহাপরিকল্পনা করে  সঠিক ঢালু ও মাপের ড্রেনেজ অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।
(৪) প্রাকৃতিক জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে খালসমূহ উদ্ধার ও খনন করে নদীর সাথে সংযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
(৫) বক্সকালভার্ড সমূহকে ভেঙে খালে পরিনত করতে হবে।
(৬) ঢাকার স্ট্রাকচারাল মহাপরিকল্পনার আওতায় চিহ্নিত জলাধার সমূহকে উদ্ধার ও খনন করতে হবে।
(৭) নিচু এলাকা, পুকুরসমূহকে সংরক্ষণ করতে হবে।
(৮) অবকাঠামো উন্নয়নের নামে বড়বড় গাছসমূহকে নিধন করা যাবে না। বরং বড় গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে।
(৯) গৃহস্থালি-বর্জ্যসহ কনস্ট্রাকশন দ্রব্যাদি ও বর্জ্য যাতে ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে তার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
(১০) ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামো এবং রাস্থার কাজের মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
(১১) অবকাঠামো তৈরির কাজের সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে।