‘রেল দুর্ঘটনা ও সুন্দরবনে জাহাজডুবি বন্ধে সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে
‘বারবার জাহাজডুবি, অরক্ষিত সুন্দরবন’
 
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন প্রশ্নহীনভাবে অরক্ষিত থাকছে। ১৪ এপ্রিল রাতে সুন্দরবনে ডুবে গেছে ৭৭৫ মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই কার্গো জাহাজ এমভি বিলাস। সুন্দরবনের পশুর চ্যানেলের হাড়বাড়িয়া এলাকায় জাহাজটি ডুবেছে। তবে এবারই প্রথম নয় এর আগেও বহুবার পূর্ব সুন্দরবন হয় জাহাজডুবি নয় সন্ত্রাসী আগুনে ঝলসেছে, চুরমার হয়েছে। একটি ঘটনারও কোনো বিচার হয়নি। বন্ধ হয়নি জাহাজডুবি, বন্ধ হয়নি আগুন। কখনো কয়লা, কখনো তেল, কখনো সিমেন্ট আর কখনোবা বিষাক্ত রাসায়নিক নিয়ে সুন্দরবনে ডুবছে জাহাজ। 
 
সুন্দরবনে জাহাজডুবির একনজর খতিয়ান:
ক্স ১৯৯৪ সনের আগস্টে মংলা বন্দরগামী একটি বিদেশি জাহাজ সুন্দরবনের পাশে বানীশান্তায় ডুবে যায় এবং ভাটিতে ২০ কি.মি. এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ে (সূত্র: পরিবেশ ও বনমন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন, ২০০২)।
ক্স মংলা বন্দরের কাছাকাছি ১৯৮৮ সনের ১ জুলাই তেল কার্গো ফুটো হয়ে সুন্দরবনে ডিজেল ছড়িয়ে পড়ে এবং একই সনের ১০ আগস্ট সুন্দবনের মাজহার পয়েন্টে ট্যাংক সংঘর্ষে উচ্চ মাত্রার সালফারযুক্ত তেলে ছড়িয়ে যায় সুন্দরবনে।
ক্স ২০১৪ সনের ৩০ সেপ্টেম্বর ৬০০ মেট্রিক টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে এমভি নয়ন শ্রি-৩ পশুর চ্যানেলে ডুবে যায়। একই সনের ১২ সেপ্টেম্বর পশুর চ্যানেলে প্রায় ৬৩০ মেট্রিক টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে এমভি হাজেরা-২ ডুবে যায়। একই সনের ২৪ নভেম্বর যাত্রীবাহী ৩ তলা লঞ্চ ‘এম ভি শাহীদুৎ’ সুন্দরবনের হরিণটানা এলাকায় ডুবে যায়। উক্ত ঘটনায় বনবিভাগ ৫০ কোটি টাকার একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করে (মামলা নং-২ হরিণ/২০১৪-২০১৫/১৪৯/চাপা)। বনবিভাগের ভাষ্য ওই লঞ্চডুবির ফলে বনের অনেক জায়গা দুমরেমুচরে গেছে, নাব্যতা সংকট তৈরি হয়েছে এবং অনেক পোণা মাছ মরেছে। ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে ‘এমটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের এক কার্গোবোট ডুবে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে শ্যালা নদীসহ চাঁদপাই রেঞ্জের প্রায় বিশটি খাল, দুটি ভাড়ানী ও বনস্তরে।
ক্স ২০১৫ সনের ২৭ অক্টোবর সুন্দরবনের শ্যালা ও পশুর নদীর মোহনায় ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ডুবেছিল এমভি জিয়া রাজ কার্গো জাহাজ। ৫ এপ্রিল ২০১৫ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীর বিমলের চরের কাছে ৫০০ মেট্রিক টন পটাশ সার (মিউরেট অব পটাশ) নিয়ে ডুবে যায় জাহাজ ‘জাবালে নূর’। 
ক্স ২০১৬ সনের ১৯ র্ম্চা সুন্দরবনের শ্যালা নদীর তাম্বুলবুনিয়ায় ১,২৩৫ মেট্রিন টন কয়লা নিয়ে ডুবে কার্গো জাহাজ এমভি সি হর্স। 
ক্স ২০১৭ সনের ১৩ জানুয়ারি সুন্দরবনের হিরণপয়েন্টের কাছে ১২ নং লালবয়া এলাকায় এক হাজার টন কয়লা নিয়ে ডুবেছিল কার্গো জাহাজ এমভি আইজগাতি। 
ক্স ২০১৮ সনের ১৪ এপ্রিল রাতে সুন্দরবনে ডুবে গেছে ৭৭৫ মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই কার্গো জাহাজ এমভি বিলাস।
কেন জাহাজ ডুবছে সুন্দরবনে?
সুন্দরবন জোয়ার-ভাটার বনভূমি। অনেক নদ-নদী, জলধারা নিয়ে সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান। আর এই নদী দিয়েই চলাচল করে জাহাজসহ ভারী জলযান। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগেই মূলত: ভারী জলযানের চলাচল বেশি। তাই এ পথেই জলযানডুবি ও তেল-দূষণের ঘটনা বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব জলযানের নির্মাণগত ত্রৃুটি তাকে এবং জলযান কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেও জাহাজডুবি ঘটে। ডুবোচরে ধাক্কা খেয়ে জাহাজের তলা ফেটে অনেক ঘটনা ঘটে। এছাড়া নিয়মবর্হিভূতভাবে অনেক যান চলাচল করে, কখনো পারমিট না নিয়ে আবার কখনোবা দুনীর্তির আশ্রয় নিয়ে। সোজা কথা হলো সুন্দরবনের মতো এমন এক সংবেদনশীল বনের ভেতর দিয়ে ভারী ও ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যিক যান চলাচলের রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও বৈধতাই সুন্দরবনে বারবার জাহাজডুবি ঘটায়। সুন্দরবনে এরকম জাহাজডুবি বহুবার হলেও কেউ কোনো পাত্তা দেয়নি। এর জন্য গঠিত হয়নি কোনো রাষ্ট্রীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি ও পাবলিক ব্যবস্থাপনা। সুন্দরবনের প্রবীণ জেলেদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, প্রতিটি জাহাজডুবি ঘটনার পরপরই আশেপাশের নদীতে মাছের পোণা ও ছোট কাঁকড়া মরে যায় এবং নদী ও খালপাড়ে চারা গাছ কিছুটা কম জন্মে। 
নৌযান ডুবে সুন্দরবনের সবচে বড় সর্বনাশটি ঘটে ২০১৪ সনে। উল্লিখিত সনে লাগাতার জাহাজ ডুবে সুন্দরবনে এবং বিষাক্ত রাসায়নিক দূষণে আক্রান্ত এই বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনটি। ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে ‘এমটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের এক কার্গোবোট ডুবে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে শ্যালা নদীসহ চাঁদপাই রেঞ্জের প্রায় বিশটি খাল, দুটি ভাড়ানী ও বনস্তরে। নিদারুণভাবে ‘এমটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের এক কার্গোবোটটি ২০১০ সন থেকেই সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়াই কেবলমাত্র পেট্টোবাংলার অনুমোদন নিয়ে এ পথে চলাচল করছিল। তেল পরিবহনের আগে এটি একটি বালি বহনকারী কার্গো ছিল। 
 
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের প্রতি চরম অবহেলা
২০১৪ সনের ডিসেম্বরে সুন্দরবনে তেল-বিপর্যয়ের পর সুন্দরবন অঞ্চলের জনগণ থেকে শুরু করে কেবলমাত্র বাংলাদেশ নয়, গোটা দুনিয়া ভেবেছিল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সুন্দরবনের প্রতি আরো মনোযোগী হবে। আরো সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল হবে। কিন্তু কোনোভাবেই তা ঘটেনি। রাষ্ট্র সুন্দরবনের উপর লাগাতার আঘাতকে অন্যায়ভাবে বৈধতা দিয়ে চলেছে। সুন্দরবনে একটি নৌযান ডুবি ও দূষণের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি। সুরক্ষিত হয়নি সুন্দরবনের প্রাণসম্পদের সার্বভৌমত্ব। তাহলে আর দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য নিয়ে এতো বৈশ্বিক দরবার করবার কী আছে! কারণ সুন্দরবনের উপর মৃত্যুআঘাত চাপিয়ে দিয়ে বৈশ্বিক জলবায়ু-দেনদরবারে সুন্দরবনকে এক গুরুত্বপূর্ণ কার্বন-শোষণাগার বলার সাহস কি বাংলাদেশ এখনো করছে? 
সুন্দরবনকে অনেকে ইউনেস্কা ঘোষিত ৫২২নং বিশ্বঐতিহ্য এবং ৫৬০তম রামসার অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করতে পছন্দ করেন। পাশাপাশি এ বন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, ইরাবতী ডলফিনের সর্ববৃহৎ বিচরণস্থল। ১৯৯৯ সনে সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কি.মি. এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। সবচে’ বড় কথা সুন্দরবন বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনভূমি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ এর ৩নং বিধি অনুযায়ী প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার জলাভূমির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন বা নষ্ট করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। পাশাপাশি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনে নৌপথসহ সকল ধরণের কর্মকান্ডই আইনত নিষিদ্ধ। বিস্ময়করভাবে ২০১১ সনে সুন্দরবনে ঘোষিত হয়েছে তিনটি ডলফিন অভয়াশ্রম। অথচ এসব সংরক্ষিত অঞ্চল কি আইন ধারা সবকিছু লন্ডভন্ড করে সুন্দরবনে চলছে ভারী জলযান, ঘটছে বিপর্যয়। প্রতিটি ঘটনার পর রাষ্ট্র একে বলে দিচ্ছে ‘দূর্ঘটনা’। 
 
জাহাজডুবি রোধে বাদাবনের জন্য জরুরি
প্রতিটি নৌযান ডুবির পর সুন্দরবনের জটিল বাস্তুসংস্থান কখনো কয়লা, সিমেন্ট, কখনো রাসায়নিক সার, কখনো তেলের নির্দয় আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েছে। তারপরও সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান টিকে থাকবার জানপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছে, এ যে প্রজাতির মৌলিক বিজ্ঞান। তার মানে এই নয় যে, একতরফা বাণিজ্য মুনাফা কিংবা রাজনৈতিক বাহাদুরি দিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির বিজ্ঞানের উপর বারবার মৃত্যুআঘাত ছুঁড়ে দিবে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের প্রশ্রয় পাওয়া কোনো করপোরেট এজেন্সি । সাম্প্রতিক কয়লা জাহাজডুবির ফলে সুন্দরবন বাস্তুসংস্থান একইভাবে আগের বিপর্যয়গুলোর মতোই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। খাদ্যশৃখংল থেকে শুরু করে বাস্তুসংস্থানের জটিল গণিত চুরমার হয়েছে। কয়লার সাথে সালফার ও সীসা দূষণ ছড়িয়ে পড়বে একটা ক্ষুদ্র বাস্তুসংস্থান থেকে বৃহৎ পরিসরে। এর ধকল সইতে হবে অণুজীব থেকে বাঘ কী বাদাবনের বনজীবীদেরও। জানি তারপরও সুন্দরবন টিকে থাকবার সংগ্রাম করে যাবে, বাংলাদেশ কি বিশ্ববাসীর স্বার্থেই। 
সাম্প্রতিক কয়লা বোঝাই জাহাজডুবির ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার জরুরি। সুন্দরবনে লাগাতার একটার পর একটা জাহাজ ডুববে আর রাসায়নিক দূষণ ঘটতে থাকবে, এটি বন্ধ করা দরকার। এর জন্য একটি বহুপক্ষীয় পাবলিক কমিটি গঠিত হতে পারে। যারা সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এমন দূষণ ও অন্যায়ের যাবতীয় তথ্য হালনাদ করবে, গবেষণা করবে এবং বারবার কর্তৃপক্ষের করণীয় বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে। ভেবেছিলাম একটা নতুন বাংলা বছরের শুরুতে বিশ্বের সবচে বড় ম্যানগ্রোভ বনটির জন্য রাষ্ট্রের কলিজায় কিছু মায়া তৈরি হবে। আশা করেছিলাম ক্ষতবিক্ষত এই অরণ্য থেকে হিংসা আর মুনাফার যন্ত্রণাদাগ গুলো সরিয়ে নেবে রাষ্ট্র। কিন্তু এই বনের উপর নির্দয় আঘাত থামছেই না? একটার পর একটা জাহাজ ডুবছে এই বনে, একটিরও সুরক্ষা কী বিচার আমরা করতে পারিনি। একবার ভাবা যায়, রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কয়লা ও রাসায়নিক বোঝাই জাহাজ চলবে এই বনের এইসব জলপথ দিয়েই। তখন কীভাবে জাহাজডুবির দূর্ঘটনা সামাল দেয়া হবে? রাষ্ট্র কী কোনো অস্বাভাবিক তেলেসমাতি হাজির করবে? 
সাম্প্রতিক কয়লাবোঝাই জাহাজডুবির ঘটনার পর শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র বনবিভাগের মাধ্যমে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে । নিশ্চিতভাবে এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রমাণ করবে ‘সুন্দরবনে কোনো ধরণের কয়লা-দূষণ ঘটবে না’। একটি কেন বিষাক্ত রাসায়নিক নিয়ে লাখো কোটি জাহাজ ডুবলেও সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হয় না বলেই হয়তো রাষ্ট্র বিশ্বাস করে। তাই এই সংবেদনশীল বনের ভেতর দিয়ে রাসায়নিক বোঝাই ভারী যান ও সুন্দরবনের আশেপাশে বিপদজনক সব শিল্পাঞ্চল গড়ার অনুমোদন ও বৈধতা দেয় রাষ্ট্র। 
ভীষণভাবে আশা করি সাম্প্রতিক কয়লা বোঝাই জাহাজডুবির ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যগত প্রভাব যাচাই হবে এবং এর পাবলিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। রাষ্ট্রকে অন্তত একটি জাহাজডুবির তদন্ত ও বিচার করে প্রমাণ করা দরকার রাষ্ট্র বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনটির প্রতি গণতান্ত্রিক আচরণ করছে। 
 
প্রস্তাব
ক্স সাম্প্রতিক কয়লাবোঝাই জাহাজডুবির ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে।
ক্স জাহাজডুবির ফলে সুন্দরবনের প্রতিবেশগত, প্রাণবৈচিত্র্যগত, সামাজিক প্রভাবগত সমীক্ষা করতে হবে এবং এর মাধ্যমে পরবর্তী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
ক্স সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা, সিমেন্ট, তেলসহ সকল রাসায়নিক বোঝাই সব ধরণের ভারী বাণিজ্যিক যান চলাচল সম্পূর্ণত বন্ধ করতে হবে।
ক্স সুন্দরবনে অব্যাহতভাবে ঘটতে থাকা জাহাজডুবি ও আগুন লাগা রোধে সমাজের নানা শ্রেণি, পেশা, সক্রিয়কর্মী, বনজীবী, পরিবেশবাদী, সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি জাতীয় সুন্দরবন সুরক্ষা সেল গঠন করা যেতে পারে। যাদের মূল কাজ থাকবে সুন্দরবনে জাহাজডুবি এবং আগুন লাগার ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ এবং এটি পুরোপুরো বন্ধে কাজ করা। 
 
‘রেল দুর্ঘটনা ঃ কারণ ও করণীয়’ 
 
 
পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, স¦াস্থ্য, মানব সম্পদ উন্নয়ন তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। যুক্তিসঙ্গত খরচে, নিরাপদে, নির্দ্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা জনগণের কাম্য। নিরাপদ, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রেল ও নৌপথের গুরুত্ব অপরিহার্য। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই নৌ পথ ও রেল পথের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা সড়ককেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। অতিরিক্তি সড়ক নির্ভরতার ফলে দূর্ঘটনা, বায়ু দূষণ, শব্দদূষণসহ নানারকম পরিবেশ দূষণ, জ্বালানি ব্যয়, যাতায়াত খরচ, যানজট ও যানজটজনিত সময়ের অপচয়সহ নানারকম সমস্যা বেড়ে চলেছে। জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে। 
 
ব্রিটিশ শাসনামলে রেলওয়ের আবির্ভাব ঘটে। বর্তমানে যে সড়কপথ আমরা দেখতে পাচ্ছি তা একশত বছর আগে কল্পনাও করা যেত না। স্থলভাগে চলাচলের জন্য রেল হচ্ছে সবচেয়ে সহজপ্রাপ্য ও সাশ্রয়ী মাধ্যম। কারণ ১ টি মালবাহী ট্রেন ১০৫টি ১০ টনি ট্রাকের সমপরিমান মালামাল পরিবহন করতে পারে। একই পরিমান ট্রাফিক ইউনিট পরিবহনে রেল ও সড়ক পথের মধ্যে ট্রেনের চেয়ে কার ৮.৩ গুণ এবং ট্রাক ৩০ গুণ পরিবেশ দূষণ করে। ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে দেখা যায়, রেলে যাত্রী প্রতি ০.৯৫-১.০৬ লিটার তেল খরচ হয়, আর বাসে যাত্রী প্রতি ৪ থেকে ৬.২২ লিটার তেল খরচ হয়। অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগের ৬৫% রেল থেকে এবং সড়ক পথ থেকে উঠে আসে ৩৫%। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ রেলে যাতায়াত করেন। দেখা যায় শীতাতাপ এ ০.০৫%, প্রথম শ্রেণীতে ১.৩৬% এবং ২য় শ্রেণীতেই যাতায়াত করেন ৯৮.০৬% যাত্রী। সুতরাং বাংলাদেশ রেলওয়ে দারিদ্রপীড়িত এই দেশে যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে বলে গণ্য করা যায়। 
 
১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে রেলওয়ের যাত্রা শুরু। ১৮৮৫ সালে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সংযোগের মাধ্যমে পূর্ববাংলায় সর্বপ্রথম এককভাবে রেললাইনের আগমন ঘটে এবং ঐ বছরই তা ময়মনসিংহ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। ১৮৬২ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বালাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট ২৮৫৮.২৩ কিমি রেললাইন স্থাপিত হয়। বর্তমানে দেশের ৪৪ জেলায় ২,৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে এবং রেলওয়ের মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ৪০,২৬৪ কিন্তু বর্তমানে কর্মরত আছেন ২৮,০৬০ জন। রেলওয়ের লোকোমটিভ এর সংখ্যা ১৯৬৯-৭০ থেকে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত ৪৮৬টি থেকে ২৮৬টি, যাত্রী পরিবহন কোচ ১৯৬৯-৭০ থেকে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত ১৬৪৩টি থেকে ১৫০৯টি এবং মালবাহী ওয়াগন ১৯৬৯-৭০ থেকে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত ৫,০৪,৮৯৩টি থেকে ১,৬৬,০১৬টিতে নেমে এসেছে। রেলওয়ের এত সংকোচনের পরও যাত্রী চলাচল আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বাংলদেশ রেলপথে পূর্বাঞ্চলে ২২৭টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২৩৯টি স্টেশনসহ মোট ৪৫৮টি স্টেশন রয়েছে। ২৮২টি লোকোমোটিভ, ১৪৮৯ টি যাত্রীবাহী কোচ এবং ৯০০৫টি ফ্রেইট ওয়াগন রয়েছে। প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সংখ্যা ৩৪০টি এর মধ্যে প্রায় ২০টির মত ট্রেন বেসরকারী কম্পানী কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে।
 
সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এবং নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে উন্নত বিশ্বে রেলপথ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। অথচ আমরা চলছি উল্টোপথে। রেলকে পঙ্গু করে দিয়ে কেবল সড়ক পরিবহন বাড়িয়ে চলেছি। বর্তমান সরকার রেলপথের সম্প্রসারণ এবং রোলিং স্টক বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন রেলগাড়ি চালু করতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। কিন্তু রেল পরিচালনায় ও ট্রেন দুর্ঘটনারোধে কর্তৃপক্ষের তেমন কোন দৃশ্যমান সফলতা চোখে পড়ছে না। ফলে রেলওয়ে যেমন স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না, পাশাপাশি যাত্রীতের প্রকৃত সেবা দিতে পারছে না রেলওয়ে। 
 
আশির দশকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসি গ্রহণ করতে বলে। ১৯৯২ সালে এডিবি রেলওয়ের কয়েকটি প্রকল্পের জন্য চুক্তি করে। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও এডিবির চুক্তির কারণে ঐ বছরই রেলের জনবল ৫২ হাজার থেকে কমে ৪০ হাজার ২৬৪ তে দাঁড়ায়। নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হলেই উচ্চ আদালতে মামলা করার সংস্কৃতি এবং বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও এডিবির চুক্তির কারণে ২২ বছর ধরে দরকারি জনবল নিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন পদ থেকে কর্মচারীরা অবসরে যাচ্ছেন। কিন্তু শূণ্য পদে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। রেলের তথ্যানুসারে অনুমোদিত পদের মধ্যে ১৫ হাজার পদ শূণ্য রয়েছে। ২০০০ সালে ২৫৬টি ট্রেনের জন্য ৫০০ জন চালক ছিলেন। বর্তমানে ট্রেন বেড়ে হয়েছে ৩৪৪ টি। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও চালকের তীব্র সংকট রয়েছে। চালক থেকে শুরু করে রেলপথ ও লেভেলক্রসিংয়ের পাহারাদারসহ অনেক পদেই লোকের ঘাটতি। স্টেশনমাস্টার, পয়েন্টসম্যান, পোর্টার, গেটকিপার, বুকিং ক্লার্ক ও সিগনাল কর্মকর্তা ও কর্মীর অভাবে শতাধিক রেলষ্টেশন বন্ধ। খালাসি, ট্রলিম্যান, ল্যাম্পম্যান, মোটরচালক, ট্রেন নাম্বার চেকার, মালামাল সহকারী, লেটারম্যান পদেও প্রয়োজনীয় জনবল নেই। অভিযোগ রয়েছে, পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ করতে না পেরে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরি প্রার্থীদের দিয়ে মামলা করান। আর তাতে আটকে যাচ্ছে নিয়োগপ্রক্রিয়া। ২০০৯ সাল থেকে ৫ বছরে উচ্চ আদালতে ৪৫টি রিট হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৯টির নিষ্পত্তি হয়েছে। প্রায় ১৫ হাাজার লোকের পদ শূণ্য রয়েছে। যার অধিকাংশ পদ রেল পরিচালনার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু স্টেশন মাস্টার এর অভাবেই ৩৫% রেল স্টেশন বন্ধ রয়েছে। ফলে যাত্রাপথে যাত্রাবিরতির সময় বৃদ্ধি পায়। এতে যাত্রীদের অসুবিধা ছাড়াও রেল লাইন ও সিগনাল পরিচালনায় জটিলতা, সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পায়। 
 
গত ২০ বছরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৫৭০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার অধিকাংশই পতিত হয়েছে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে। যথাযথ সিগন্যালের অভাব, লাইনের ত্রুটি ও যাত্রীদের অসাবধানতার কারণেও ব্যাপক সংখ্যক রেল দুর্ঘটনা ঘটেছ। টঙ্গী থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত প্রায় ২৬ কিলোমিটার রেললাইন যেন মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছরে প্রায় এক হাজার রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশই লেভেল ক্রসিংজনিত দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৪ টাকা। বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) কমলাপুর থানা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৯২ জন। অপমৃত্যু মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা ২৮৫টি। ২০১৬ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৩০৫ জন। চলতি এপ্রিলের পূর্ববর্তী ১৫ মাসে মারা গেছেন ২৭৮ জন। শুধু গেন্ডারিয়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ঢাকা মহানগর এলাকায় রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৯৩ জন। (সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৭ এপ্রিল ২০১৮)
 
আমাদের রেলপথের প্রায় সবই অরক্ষিত। ট্রেন দুর্ঘটনার ধরন প্রধানতঃ লাইনচ্যুতি, লেভেলক্রসিং, ইঞ্জিন বিকল, সিগনাল অমান্য করা এবং চালকের অসাবধানতা। ঘন ঘন ট্রেন লাইনচ্যুতির ফলে একদিকে হতাহতের ঘটনা ঘটছে, অপরদিকে যাত্রীদের চরম ভোগান্তীতে পড়তে হচ্ছে। এর প্রধান কারণ রেলপথ পাহারা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ওয়েম্যান নেই এবং যারা আছেন তারাও নিয়মিতভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। এছাড়াও জনবলের অভাব, রেল লাইন নিয়মিত মেরামত না করা, ইঞ্জিন ও বগি যথাযথভাবে মেরামত না করা, মেরামত কারখানায় দক্ষ জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব এবং রেল কর্মকর্তাদের গাফিলতি ট্রেন লাইনচ্যুতির কারণ। বাস্তবে রেল কর্তৃপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে ট্রেন দুর্ঘটনা। প্রতিবছর দুর্ঘটনার এ হার বেড়েই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে যাত্রী সংকটে পড়বে রেল।
 
গত ১৫ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার গাজীপুর টঙ্গী রেলওয়ে জংশনের অদূরে ঢাকাগামী জামালপুর ট্রেনের চারটি বগি লাইনচ্যুত হলে ঘটনাস্থলেই তিনজন এবং পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন নিহত হন। এছাড়াও ট্রেনের যাত্রী, পথচারীসহ আহত হন কমপক্ষে ৩০ জন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল রেলের ছাদ-এর যাত্রী। ট্রেনটি এস আর ট্রেডিং নামক বেসরকারী কম্পানী কর্তৃক পরিচালিত। প্রাইভেট এই দূর্ঘটনার কারণে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ। দীর্ঘ ছয় ঘন্টার পর তা স্বাভাবিক হয়। প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে, কারিগরি ক্রটির কারণে এ দূর্ঘটনা ঘটেনি। ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেশনমাস্টার ও সংকেতব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে এ দূর্ঘটনা ঘটেছে।
 
এসব দুর্ঘটনা কেবলই দুর্ঘটনা নাকি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ তা খতিয়ে দেখা দরকার। সাধারণের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে, সড়ক পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক ও দেশের একটি মহল তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে এই দুইটি টেকসই মাধ্যমকে পঙ্গু করে রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। রেলপথে ১লা জানুয়ারী হতে ১২ নভেম্বর/২০১৪ পর্যন্ত সংঘঠিত বড় দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এ সময়কালে মোট ১৩৩টি দুর্ঘটনা সংঘঠিত হয়। এসব দুর্ঘটনার ধরন ঃ  লাইনচ্যুতি ৮৪টি (যা মোট দুর্ঘটনার ৬৩.১০%), রেল-রোড ক্রসিংজনিত ২৩টি  ( যা মোট দুর্ঘটনার ১৭.৩০%),  পাটিং বা বিভক্তিজনিত ৬টি (যা মোট দুর্ঘটনার ৪.৫০%),  সিগনাল অমান্য ৫টি ( যা মোট দুর্ঘটনার ৩.৮০%),  অন্যান্য ১৫টি ( যা মোট দুর্ঘটনার ১১.৩০%)। ৪টি দুর্ঘটনা ঘটে সড়কযান রেল ট্র্যাকে প্রবেশ/ পার্শ্ব সংঘর্ষ (সড়কযানের সাথে) এর মাধ্যমে এবং তা ঘটে  পশ্চিমাঞ্চলে। দুর্ঘটনার ফলে স্ষ্টৃ ক্ষয়ক্ষতি ঃ ৪৪ জনের প্রাণহানী  ঘটে এবং ১০৪ জন আহত হন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের সময়কাল ৫৪৭ (৭৮ টি দূর্ঘটনায়) ঘন্টা। রেলের ক্ষয়ক্ষতি (প্রকৌশল, যান্ত্রিক, সংকেত, বাণিজ্যিক, তেল, অগ্নিকান্ড) ১,৭৫,৫৮,৪৮৯ (৪৫টি দূর্ঘটনায়) টাকা। 
 
লাইনচ্যুতি হচ্ছে মোট দুর্ঘটনার শতকরা ৬৩ ভাগের উপরে। এসব দুর্ঘটনা বাস্তবে দুর্ঘটনা নয়। রেল কর্তৃপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও উদাসীনতা, রেল লাইন সার্বক্ষণিক মনিটর ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, চালকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের অসর্তকতার অভাবে এসব দুর্ঘটনা সংঘঠিত হয়েছে। রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে লাইনচ্যুতি পুরাপুরি রোধ করা সম্ভব। রেল-রোড ক্রসিংজনিত দুর্ঘটনা লেভেলক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধকতা স্থাপন ও প্রহরীর নিয়োগের মাধ্যমে বন্ধ করা সম্ভব। দুর্ঘটনা ঘটলেই তদন্ত কমিটি হয়, দফায় দফায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সাক্ষ্য গ্রহণ চলে তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল হয়। দোষী রেল কর্মীদের হালকা শাস্তি প্রদানের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় সবকিছু। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনের দেওয়া সুপারিশের আলোকে কোনো কিছুই করা হয় না, সমাধান হয় না ত্রুটি-বিচ্যুতির। ফলে ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়েই চলে জ্যামিতিক হারে।
 
সুপারিশ:
ক্স রেল লাইন সার্বক্ষণিক মনিটর করা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা, যাত্রার পূর্বে লোকোমটিভ ও যাত্রী কোচ ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, সিগনাল কার্যকর রাখা ও তা মেনে ট্রেন পরিচালনা করা, নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে ট্রেন পরিচালনা না করা, সাবধানতার সাথে ট্রেন পরিচালনা করা যাতে হঠাৎ ব্রেক করতে না হয়, লেভেলক্রসিংয়ে সাময়িকভাবে স্থানীয়দের দৈনিকভিত্তিক প্রহরী নিয়োগ দেয়া;
ক্স দূর্ঘটনায় দায়ী সংশ্লিষ্টদের যথাযথ শাস্তি প্রয়োগ করা; তদন্ত কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলকে তদন্তের কপি প্রেরণ করা।
ক্স রেল লাইন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা, রেলওয়ের লোকবল বৃদ্ধি করা, রেলওয়ের লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ ও মালবাহী ওয়াগন বৃদ্ধি করা; রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়নে এবং রেলের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নে কারখানাগুলোকে কার্যকর করা; 
ক্স ঝুঁকিপূর্ণ রেল সেতু দ্রুত সংস্কার বা পুনঃনির্মাণ করা, লেভেলক্রসিংয়ে গেট বসানো ও প্রহরী নিয়োগ দেয়া;
ক্স রিট মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিপূর্বক তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর বিভিন্ন পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করা।
ক্স অতি দ্রুত রেল দুর্ঘটনার চলমান হার কমাতে বা বন্ধ করতে রেল কর্তৃপক্ষকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় রেলের শত বছরের সুনামই শুধু নষ্ট হবে না বরং রেল ধ্বংস  হয়ে যাবে।
ক্স রেল ও নৌ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ করা এবং সড়ক নির্ভরতা কমানো;