“খাদ্য চেইন-এ প্লাস্টিকের উপস্থিতি ঃ হুমকিতে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য”
২২ এপ্রিল ধরিত্রী দিবস। ধরিত্রী দিবসের এবছরের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক বর্জ্যরে সমাপ্তি’ (ঊহফ চষধংঃরপ চড়ষষঁঃরড়হ)। প্লাস্টিক পদার্থের নিয়মিত ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অপচ্য এ পদার্থ পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করছে। ফলে মাটি, পানি দূষিত হয়ে যাচ্ছে। এতে খাল-বিল, নদী-নালা থেকে শুরু করে মহাসমুদ্র পর্যন্ত প্লাস্টিক পদার্থ ও প্লাস্টিক কণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে উন্নত বিশে^র প্রসিদ্ধ কম্পানির বোতলজাত পানিতেও বিষাক্ত প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে বিশে^র সকল স্তরের জীববৈচিত্র্য আজ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন। অনুজীব থেকে শুরু করে তিমি মাছ পর্যন্ত মরাত্মক হুমকিতে। ফুড চেইনের মাধ্যমে অন্যান্য প্রাণিসহ আমরাও মারাত্মক হুমকিতে রয়েছি। বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধর আইন থাকলেও এর কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না। তদুপরি প্লাস্টিক পদার্থ উৎপাদন, ব্যবহার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কোন আইন নেই, নেই সচেতনতা। সেই সাথে এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনাও হচ্ছে না। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র উদ্যোগে আজ ২১ এপ্রিল ২০১৮, শনিবার, সকাল ১১.০০টায়, পবা কার্যালয়ে, ধরিত্রী দিবস উপলক্ষ্যে “ পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা”-শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। 
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে উক্ত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন স্টামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার এবং মূখ্য বক্তা হিসাবে বক্তব্য রাখেন, পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান, অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, পবা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. লেলিন চৌধুরী, সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ,  নাসফ-এর সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী, সাউথ-ইস্ট বিশ^বিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের জেষ্ঠ প্রভাষক জুবাইদা গুলশান আরা, নাসফের আইন বিষয়ক সহ সম্পাদক মো. ওমর ফারুক, বিসিএইচআরডি-র পরিচালক মো. মোনতাজুর রহমান মোহন, হীল-এর পরিচালক জেবুন নেসা, সবুজ ছাতা হেল্থ কেয়ার লিঃ এর এমডি মো. শরিফুজ্জামান খান সাঈদ, পবা’র সদস্য মোসতারি বেগম প্রমুখ। 
 
ড. কামরুজ্জামান মজুমদার তার মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, প্লাস্টিক শুধু আসবাবপত্র বা পলিথিনের ভিতরে সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে নামিদামি কসমেটিক কোম্পানীর  সাবান, ফেসওয়াস, টুথপেস্ট, বডিওয়াস, ডিটারজেন্ট ইত্যাদিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিতে মাইক্রোবিড নামক ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি দেখা যায়। যা ব্যবহারের পর নদী-নালা, খাল-বিল ও অন্যান্য জলাশয়ে পতিত হচ্ছে এবং মাছের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। তিনি পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগের বিকল্প হিসাবে পাট, কাপড়, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা ব্যবহার করা, এগুলো সহজলভ্য করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
 
অন্যান্য বক্তারা বলেন, প্লাস্টিক দূষণ আমাদের নদী, সাগর, মহাসাগর ও ভূমিকে বিষাক্ত করছে, সামুদ্রিক জীবন ক্ষতিগ্রস্থ করছে এবং জনস্বাস্থ্যে বিরুপ প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশে সরকার ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার  নিষিদ্ধ করে। কিন্তু এই আইনের কোন বাস্তবায়ন নেই। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় এক হাজার দুই শত কারখানা নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরী হচ্ছে। এগুলোর বেশীর ভাগই পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক। ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটির বেশী পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশী টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ পলিথিনের হলেও কাপড়ের ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
বক্তারা আরো বলেন, এবছর বিশ্বে ৫ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার হবে। যা প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৬০ হাজার। এগুলো একটির পর আরেকটি রাখা হলে তা প্রতি ঘন্টায় পৃথিবী সাত বার ঘুরবে এবং ফ্রান্সের দ্বিগুন এলাকা আচ্ছাদন করবে। এর দশ শতাংশেরও কম পুনব্যবহারযোগ্য করা হয়। এগুলোর বেশির ভাগই পলিইথিলিন যা ক্ষয় হতে কয়েক শত বছর লাগে। প্রতি টন প্লাষ্টিক ব্যাগ পুনব্যবহারযোগ্য করা হলে তা ১১ ব্যারেল তেল সমতুল্য শক্তি সংরক্ষণ করে। তারা বলেন, প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক সমুদ্রে জমা হয়। সমুদ্রে প্লাস্টিক অতি ক্ষুদ্র টুকরায় ভেঙ্গে যায়। এসব টুকরা মাছ খায় কিন্তু হজম হয় না। মাছের পেটে জমা হতে থাকে এবং খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে। 
 
এক সমীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে ১৫ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, যা ২০১০ সালে  ৭ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। ২০ বছরে ব্যবহার ৫০ গুণ বেড়েছে। বর্তমানে ছোট,মাঝারি, বড় ৫ হাজার শিল্পকারখানায় ১২ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। সে হিসাবে প্লাস্টিক পণ্যের জনপ্রতি ব্যবহার বছরে ৭.৫ কেজি।
 
৬ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঊহারৎড়হসবহঃ চৎড়মৎধস (টঘঊচ) আয়োজিত এক সভায় ১৯৩ টি দেশের প্রতিনিধি সমুদ্রের পানিতে প্লাস্টিক দূষণ অবসানের জন্য জাতিসংঘের রেজুলেশনে স্বাক্ষর করেন, এর মধ্যে আমাদের বাংলাদেশেও রয়েছে। পলিথিন নিষিদ্ধকরণ আইন এবং পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে, কাগজ ও কাপড়ের ব্যাগের ব্যবহার বাড়বে, মাঠ পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাটের ব্যাগ আমেরিকায় রপ্তানীর উদ্যোগ নেয়া হলে রপ্তানী আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষক পাট চাষে উৎসাহিত হবে এবং পাটের ন্যায্য মূল্য পাবে। বাংলাদেশ সোনালী আঁশ পাটের ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
 
সুপারিশ সমূহ:
 
ক্স পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।
ক্স পলিথিন শপিং ব্যাগ ও টিস্যু ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ক্স পলিথিন নিষিদ্ধকরণ আইন (২০০২) অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন (২০১০) প্রচলন করা। 
ক্স পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড়, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা ব্যবহার করা, এগুলো সহজলভ্য করা এবং এসব ব্যাগ ও ঠোংগা ব্যবহাওে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
ক্স প্লাস্টিক প্রত্যাখ্যান, হ্রাস, পুনঃব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার লক্ষ্যে ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনে আমাদেরকে সচেষ্ট হতে হবে।
ক্স পরিবেশ অধিদপ্তর, পাট অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফ বি সি সি আই, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।
ক্স প্লাস্টিক প্রত্যাখ্যান, হ্রাস, পুনঃব্যবহারের ক্ষেত্রে জনসচেতনা সৃষ্টি করা।