দারিদ্র বিমোচন ও স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের স্বার্থে সকল কর্মপরিকল্পনায় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রাধান্য দিতে হবে
২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। এবছরের প্রতিপাদ্য ‘ঈবষবনৎধঃরহম ২৫ ণবধৎং ড়ভ অপঃরড়হ ভড়ৎ ইরড়ফরাবৎংরঃু’। জীববৈচিত্র্য দিবসের প্রতিপাদ্য ২০১৫ সালে নির্ধারিত হয়েছিল ‘জীববৈচিত্র্য ও টেকসই উন্নয়ন’ এবং ২০১০ সালে ‘জীববৈচিত্র্য, উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন’। এ প্রতিপাদ্য দুটি থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, টেকসই উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে জীববৈচিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। জীববৈচিত্র্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বায়ু নিঃশ্বাসযোগ্য রাখা, খাদ্য, পানি সরবরাহ, ওষুধ, পোষাক পরিচ্ছদ, আশ্রয়স্থলের যোগান দিচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার লক্ষ্য-১ হচ্ছে দারিদ্র বিমোচন, যা খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। জীববৈচিত্র্য হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। বিশ্ব অর্থনীতির ৪০ শতাংশ এবং দরিদ্র জনগোষ্টির চাহিদার ৮০ শতাংশ আসে জৈব সম্পদ থেকে। জীববৈচিত্র্য টেকসই উন্নয়ন ও মানব কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ দীর্ঘ আট বছরেও উন্নয়নকে প্রাণের বৈচিত্রময় বিস্তার ও বিকাশের দৃষ্টিতে দেখেনি। বরং মূলধারায় উন্নয়ন কর্মকান্ড অনেকক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছে জীববৈচিত্র্য সংহারী। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র উদ্যোগে আজ ২২ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, সকাল ১১.০০টায়, পবা কার্যালয়ে, আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষ্যে-“দারিদ্র বিমোচনে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব”-শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। 
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে উক্ত গোলটেবির বৈঠকের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান, অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, পবা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. লেলিন চৌধুরী, নাসফ-এর সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী, বিআইডাব্লিউটিএ এর সাবেক নির্বাহী প্রকৌ. তোফায়েল আহমেদ, নিরুপমা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট নাজনীন নিরুপমা তিথি, বানিপা’র সভাপতি প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন, কবি কামরুজ্জামান ভূঁইয়া, স্পার্সো-র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ওবায়দুল কাদের, ইয়ুথ সান-এর সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পী, ডাব্লিউবিবি-ট্রাস্ট এর প্রজেক্ট অফিসার সামিউল হাসান, পবা’র সদস্য মোসতারী বেগম, মার্শাল আর্ট ফাউন্ডেশন-এর নির্বাহী পরিচালক সুমন মাহমুদ প্রমুখ। 
 
আবদুস সোবহান বলেন, বর্তমান বিশে^ সকল প্রাণীর খাদ্য নিরাপত্তা আজ হুমকির সম্মুখীন। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষেণের মাধ্যমে সকল প্রাণীর খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব। কিন্তু উন্নয়নের নামে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করে আমরা টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনীতির সমৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্থ করছি। আমাদের অস্তিত্ব, স্থায়িত্বশীল উন্নয়নসহ দারিদ্র বিমোচনে জীববৈচিত্র্যের কোনো বিকল্প নেই।
 
বাংলাদেশে ৩০০ টির বেশী নদী রয়েছে। যার মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। পদ্মা, মেঘনা, যুমনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী। এদের অসংখ্য উপনদী ও শাখানদী রয়েছে। যুগ যুগ ধরে এদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা আবর্তিত হচ্ছে নদীকে কেন্দ্র করে। পাশাপাশি নদী পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্যের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বছরে ১.২- ২.৪ বিলিয়ন টন পলি নদীবাহিত হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, বাঁধ নির্মাণসহ উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে পলি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে বাংলাদেশের নদীর তলদেশ ভরাট যাচ্ছে। দেশের প্রায় ১৪০ টি নদ-নদী এখন মৃত প্রায়। দেশের প্রায় ১৩টি নদীর অস্তিত্ব এখন বিলীনের পথে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের মানচিএ থেকে হারিয়ে যাবে এসব নদী। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১২০ প্রজাতির দেশি মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে আরো ৪৫ প্রজাতির মাছ হুমকির সম্মুখীন। 
 
বিভিন্ন অঞ্চলের বন ও বন্যপ্রাণী মিলে গড়ে উঠেছে প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। বন ও বন্যপ্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবেশ, প্রতিবেশব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্যের ওপর নেমে আসে বিপর্যয়। বন্যপ্রাণীর জীবনযাপন যেমন বনের উপর নির্ভরশীল তেমনি বনের স্বাভাবিক ভারসাম্যও বন্যপ্রাণীর উপর নির্ভরশীল।  বাংলাদেশে প্রায় ৯৮২ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিচরণ করে। এর মধ্যে ৫৩ প্রজাতির উভচর, ১৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬৫০ প্রজাতির পাখি এবং ১২১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
 
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে সংরক্ষিত বনের মধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প স্থাপন এবং বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপকহারে গাছ কাটা হচ্ছে। তিতাস গ্যাসের সঞ্চালন পাইপ লাইন নির্মাণের শ্রীপুর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১৩ হাজার ৩৫৬টি, মহেশখালীতে বিপিসির টার্মিনাল এবং কাপাসিয়ায় মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য ৩ হাজার ২৪৭টি গাছ কাটা হবে। যশোর রোডের ঐতিহ্যবাহী গাছগুলো কাটা নিয়ে অনেক সমালোচনা-প্রতিবাদের পর গাছগুলো রেখেই রাস্তা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর পরেও মানিকগঞ্জে হাজার হাজার গাছ কেটে রাস্তা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। মানবিক সংকটে পড়া রোহিঙ্গাদের জন্যও ৪ হাজার ৮৩ একর বনভ’মিতে আশ্রয় শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। বন বিভাগ এ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি একর বনভ’মি বরাদ্দ দিয়েছে। এক বছরের মধ্যে আরও ১৬ হাজার একর বনভ’মি বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। অথচ ২০১৬ সালে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত  নেয়া হয় যে ২০২২ সাল পর্যস্ত বনের গাছ কাটা যাবে না। 
 
বক্তারা বলেন, বিশ্বের একক সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বাংলাদেশের সুন্দর বন। যার আয়তন প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনে বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বসবাস। রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের জাতীয় পশু এবং সুন্দরবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রায় ১২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনের অংশবিশেষ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইক্লোন, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ, বনজ সম্পদের নির্বিচার আহরণ, বন্যপ্রাণী শিকার, ইত্যাদি কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববেচিত্র্যের এক অনন্য নিদর্শন সুন্দরবন। সুন্দরবনকে রক্ষা করে বাঘ। আর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষাকরে সুন্দরবন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের  ২০১০ সালের ৪র্থ প্রাণবৈচিত্র্য অবস্থানপত্র  অনুযায়ী  সুন্দরবনে ২০০৪ সালে ৪৪০টি, ২০০৬ সালে ২০০টি বাঘ ছিল।  ২০১৫ সালে বাঘের সংখ্যা  মাত্র ১০৬টি। গত ৫০ বছরে সুন্দরবন থেকে ৩২ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গিয়েছে (দি গার্ডিযান ২০১৫)।
 
বাংলাদেশের জীবজন্তুর সর্বশেষ লাল তালিকা অনুযায়ী (আইউসিএন বাংলাদেশ ২০১৫) ৩৯০ প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন। যা জরিপকৃত ১৬১৯ প্রজাতির প্রায় ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে ৫৬টি সংকটাপন্ন, ১৮১টি বিপন্ন এবং ১৫৩ বিপদাপন্ন। আইউসিএন লাল তালিকা ২০০০ অনুযায়ী গত ১০০ বছরে ১৩টি বন্যজীবী প্রজাতি হারিয়ে গিয়েছে। আইউসিএন লাল তালিকা ২০১৫ অনুযায়ী গত ১৫ বছরে আরও ১৮ প্রজাতি বিলুপ্ত তালিকায় যুক্ত হয়েছে। যা আমাদের জন্য একটি অশনিসংকেত।
 
বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য কনভেনশন ১৯৯২ সালে স্বাক্ষর এবং ১৯৯৪ সালে অনুস্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদ এর পক্ষ হিসেবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ দায়বদ্ধতা পূরণে বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের ১৮ক অনুচ্ছেদে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা রয়েছে। বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন, ২০১৭ প্রনয়ণ করা হয়েছে। আইনে জীববৈচিত্র্য বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও কারিগরি কমিটি, সিটি করপোরেশন জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা ও তদারক কমিটি, জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা ও তদারক কমিটি, ইউনিয়ন জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা কমিটি, তৃণমূল পর্যায়ে জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা দল, সমিতি, উপ-কমিটির উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। বাংলাদেশ বায়োডাইভার্সিটি ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট ২০১৫ প্রস্তুত করেছে। ২০০৪ সালে  বায়োডাইভার্সিটি স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছে।
 
দেশের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জীববৈচিত্র্যের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের বেঁচে থাকার উপকরণ পাই। পরিবেশ ও প্রতিবেশের সম্পদ প্রান্তিক ও গরিব মানুষের কল্যাণে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে কার্যকরভাবে দারিদ্র কমানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন এসব সম্পদে সুবিধাবঞ্চিত, প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করা এবং প্রাকৃতিক প্রতিবেশের সুরক্ষা করা। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের অবিচ্ছেদ্য পদ্ধতি হচ্ছে উপযুক্ত সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়ন কৌশল।  
 
করণীয়
ক্স পরিবেশ ও প্রতিবেশের সম্পদে সুবিধাবঞ্চিত, প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করা।
ক্স সকল সেক্টরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রাধান্য দেয়া।
ক্স জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদী কার্যকর গবেষণা পরিচালনা করা।
ক্স সরকার, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা জাতীয় পর্যায়ে নিযমিতভাবে জীববৈচিত্র্য জরিপ সম্পন্ন করা।
ক্স ভূতাওি¦ক, জলজ ও সামুদ্রিক পরিবেশে জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্রের সেবাগুলো সংরক্ষণ ও পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ক্স বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক পদ্ধতিতে জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা।
ক্স ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি এবং ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া।
ক্স উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকূলে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বরাদ্দ প্রদান না করা। 
ক্স উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা। 
ধন্যবাদসহ