“পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হোক”
আজ বিশ^ পরিবেশ দিবস। ‘আসুন প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করি’ (ইবধঃ চষধংঃরপ চড়ষষঁঃরড়হ) প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ^ব্যাপি দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণের পরিবেশগত বিপর্যয় উত্তরণের জন্য একটি টেকসই উপায় হচ্ছে ব্যবহার কমানো এবং পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়ন বাড়ানো। প্লাস্টিকের বোতল ও বিভিন্ন সামগ্রী এবং পলিথিন ব্যাগের অধিকাংশই পুনর্ব্যবহার, পুনঃচক্রায়ন না করে  প্রাকৃতিক পরিবেশে যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। যা পরবর্তীতে খাল, নদী, সমুদ্রে জমা হচ্ছে। সেখান থেকে জলজ প্রাণী তা গ্রহণ করছে। এসব প্রাণীর মাধ্যমে তা খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। জনজীবন, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে সরকার আইন করে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। আইনের প্রয়োগে শিথিলতার কারণে র্তমানে সারা দেশে পলিথিনের ব্যবহার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই অবিলম্বে পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হোক। বিশ^ পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র উদ্যোগে আজ ০৫ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, সকাল ১১.০০টায়, পবা কার্যালয়ে, “প্লাস্টিক দূষণ ঃ পরিবেশের জন্য হুমকি ও আমাদের করণীয়”-শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। 
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান-এর সভাপতিত্বে এবং সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলের সঞ্চালনায় উক্ত সেমিনারে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন পবা’র সহ-সম্পাদক স্থপতি শাহীন আজিজ, বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের চেয়ারম্যান প্রকৌ. আনোয়ার হোসেন, সামাজিক আন্দোলন সংস্থার চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর হিরু, স্পারসোর প্রাক্তন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ওবাইদুল কাদীর, সেতু সংঘের প্রতিষ্ঠাতা মো. ইলিয়াস হায়দার, নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি হাজী শেখ আনসার আলী, নারী মৈত্রীর শিরিন আক্তার, পবা’র সদস্য মোস্তারী বেগম, প্রকৌ. মো. কামাল পাশা মিয়া, এলিজা রহমান, মো. মেহেদি আক্তার প্রমুখ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান  
 
প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান তার মূল প্রবন্ধে বলেন,  ১৯৫০ দশক থেকে বিশ্বে উৎপাদিত প্লাস্টিকের পরিমাণ মোট ৮.৩ বিলিয়ন মেট্রিক টন। যার মধ্যে বর্জ্য হচ্ছে ৬.৩ বিলিয়ন টন। এবর্জ্যরে নয় শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা এবং বার শতাংশ পোড়ানো হয়েছে। বাকি বর্জ্য ভ’মি ভরাট বা প্রাকৃতিক পরিবেশে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশ, ফ্রান্স, রুয়ান্ডা প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কেনিয়ায় গত বছর হতে কেউ দোষী সাব্যস্ত  হলে তার চার বছর জেল বা চল্লিশ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা হবে। জানুয়ারি মাসে চীন প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৩০ সাল নাগাদ প্লাস্টিক বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহার ৩০ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশে উন্নীত করার ‘প্লাস্টিক কৌশল ’ গ্রহণ করেছে। ২০১৫ সালে বৃটেনে প্লাস্টিক শপিং ব্যাগে কর বসানোর ফলে এর ব্যবহার ৮৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। 
 
সাগর-মহাসাগর দূষণের দুই তৃতীয়াংশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ২০টি নদী থেকে আসে এবং এগুলোর অধিকাংশ এশিয়াতে। এ তালিকার শীর্ষে চীনের ইয়াংঝি (ণধহমঃুব) নদী। যা প্রায় তিন লক্ষ ত্রিশ হাজার টন প্লাস্টিক পূর্ব চীন সাগরে বহন করে। গঙ্গা নদীর অবস্থান দ্বিতীয়। যা ভারত ও বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গিটারস একটি গবেষণার উল্লেখ করে বলেছেন যে ২০৫০ সালের মধ্যে যদি কিছু করা না হয় তাহলে প্লাস্টিকের পরিমাণ মাছের চেয়ে অধিক হতে পারে। প্রতি বছর আট মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পড়ছে। যার ফলে অন্তত আট বিলিয়ন ডলারের সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং আনুমানিক এক মিলিয়ন সামুদ্রিক পাখি, এক লক্ষ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী ও অবর্ণনীয় সংখ্যক মাছ মারা যাচ্ছে।
 
বাংলাদেশে উৎপাদিত প্লাস্টিকের বোতল ও বিভিন্ন সামগ্রী এবং পলিথিন ব্যাগের অধিকাংশই পুনর্ব্যবহার, পুনঃচক্রায়ন না করে  প্রাকৃতিক পরিবেশে যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। যা পরবর্তীতে খাল, নদী, সমুদ্রে জমা হচ্ছে। সেখান থেকে জলজ প্রাণী তা গ্রহণ করছে। এসব প্রাণীর মাধ্যমে তা আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে ১৫ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, যা ২০১০ সালে  ৭ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। ২০ বছরে ব্যবহার ৫০ গুণ বেড়েছে। বর্তমানে ছোট, মাঝারি, বড় ৫ হাজার শিল্পকারখানায় ১২ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। প্লাস্টিক পণ্যের জনপ্রতি ব্যবহার বছরে ৭.৫ কেজি।
 
২০০২ সালে আইন করে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও আইনের কোন বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় এক হাজার দুই শত কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরী হচ্ছে। এগুলোর বেশীর ভাগই পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটির বেশী পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশী টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ পলিথিনের হলেও কাপড়ের ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
 
পরিবেশ ও বন মন্ত্রীর গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যের সমালোচনা করে আলোচকরা বলেন পলিথিন নিষিদ্ধের আইন প্রণয়নের পর তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের ফলে বিকল্পের চাহিদা দেখা দেয় এবং তা বাজারে চলে আসে। পলিথিনের বিকল্প হিসাবে জনগণের চাহিদার প্রেক্ষিতে কাগজের ব্যাগ, প্যাকেট ও ঠোঙা, কাপড়ের ব্যাগ, চটের ব্যাগ, পাটের বিভিন্ন সামগ্রী বাজারে চলে আসে। ঢাকার বিভিন্ন বাজারে এসব বিকল্পের পাইকারি দোকান গড়ে ওঠে। এছাড়াও জনগণ বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে বাজারে যেতেন। বিকল্প তৈরিতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে গ্রামীন নারীদের। পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এর ফলে জনজীবন, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতার ক্ষেত্রে। আইনের প্রয়োগে শিথিলতায় বিকল্পের চাহিদা কমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা শূণ্যের কোটায় নেমে আসে। নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন বন্ধ হলে বিকল্পের চাহিদা সৃষ্টি হবে এবং তা বাজারে চলে আসবে। আইন প্রয়োগে শিথীলতা এবং জনসচেতনতা ধরে রাখার ব্যর্থতার কারণে পলিথিন সমহিমায় আবার তার পূর্বের অবস্থান ফিরে আসে। এমনকি আগের চেয়েও বেশি ব্যবহার হচ্ছে। এবছরসহ গত দুই তিন বছর একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকা মহানগরীতে যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, তার অন্যতম প্রধান কারণ পলিথিন প্লাস্টিক। এগুলো পানি চলাচল ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি করে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখে।
বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালে সকল বা যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। একই সালের ০৪ মে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের এস আই/সমপর্যায় হতে এ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ পর্যন্ত; মেট্রোপলিটন বহির্ভূত এলাকায় এস আই/সমপর্যায় হতে সহকারী পুলিশ সুপার পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তাগণকে “পরিদর্শক” এর ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
 
বক্তারা আরো বলেন পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা দেশের জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নের ফলে পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তায় বর্তমানে সারা দেশে পলিথিনের ব্যবহার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা। পাশা পাশি রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব। 
আসুন আমরা জনগণ বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাই, খাদ্য সরবরাহবারীকে নন-প্লাস্টিক প্যাকেজিং ব্যবহারে চাপ প্রয়োগ করি, পানির বোতল কেনা এড়িযে চলি, নিজের বোতল সঙ্গে রাখি, প্লাস্টিক কাটলারি বর্জন করি। নিজেদের এবং পরবর্র্তী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমাদেরকে পরিবেশ সংরক্ষণের সংগ্রামকে আরো বেগবান করতে হবে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি প্রতিদিনই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
 
করণীয় : 
ক্স পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় ভ’মিকা পালন করা।
ক্স পলিথিন শপিং ব্যাগ ও টিস্যু ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। 
ক্স নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
ক্স পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা  ইত্যাদি সহজলভ্য করা এবং এগুলো ব্যবহারে জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করা।
ক্স বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানীকৃত পলি প্রোপাইলিন পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। টিস্যু ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল আমদানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ক্স পরিবেশ অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
ক্স প্লাস্টিক বর্জন, হ্রাস, পুনঃব্যবহারের ক্ষেত্রে জনসচেতনা সৃষ্টি করা।
ক্স প্লাস্টিক বর্জন, হ্রাস, পুনঃব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার লক্ষ্যে ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনে নাগরিকদের সচেষ্ট হওয়া।
ক্স প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলায় সরকার বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।