“বাজেটে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নে পরিবেশ-প্রতিবেশকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে”
এবারের জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবিত বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। যা মোট বরাদ্দের ০.৪ শতাংশ। গত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। যা সংশোধিত বাজেটে মাত্র ৮৯১ কোটি টাকা করা হয়েছে। অথচ স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য পরিবেশ ও প্রতিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশের অন্যতম উপাদান নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি। কিন্তু নদ-নদী দখল, ভরাট ও দূষণ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পানি ও বায়ু দূষণ, শিল্পকারখানার দূষণ, মাত্রাতিরিক্ত ও ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার, ভূগর্ভস্থ পানির অত্যাধিক উত্তোলন, জলবায়ু পরিবর্তন,  ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য ইত্যাদির কারণে পরিবেশ প্রতিবেশ আজ হুমকির সম্মুখিন। কিন্তু এবারের বাজেটে  এ ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও গুরুত্বারোপ করা হয়নি। তাই বাজেটে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নে পরিবেশ-প্রতিবেশকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আজ ১১ জুন ২০১৮, সোমবার, সকাল ১১ টায়, পবা কার্যালয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র উদ্যোগে “প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা, পরিবেশসম্মত উন্নয়নে বাজেট ও ব্যবস্থাপনা”- শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা  উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। 
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন, পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী, বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন-এর চেয়ারম্যান প্রকৌ. আনোয়ার হোসেন, নারী মৈত্রীর শিরিন আক্তার, বাংলাদেশ যুব সমিতির সভাপতি মো. আকতার হোসেন, পুষ্পসাহা পুকুর রক্ষা কমিটির সভাপতি নাসির খান মিন্টু, ডাব্লিউবিবি-ট্রাস্ট এর সৈয়দ সাইফুল আলম, ট্যালেন্ট প্রমোশন ইনিসিয়েটিভ-এর প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল মান্নান, পবা’র সদস্য, এ্যাড. এলিজা রহমান, শাকিলা শফিক, কায়সার আহমেদ প্রমুখ।  
 
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরিসংখ্যান মতে জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এবং ক্রয় ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ৩২তম। চৎরপব ডধঃবৎযড়ঁংব ঈড়ড়ঢ়বৎং-এর প্রক্ষেপণ মতে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ২৮তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ২৩তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ অর্জন ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করতে হবে। আর এসব উন্নয়ন হতে হবে টেকসই ও স্থায়িত্বশীল। এ লক্ষ্যে পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
 
বক্তারা আরো বলেন, বিগত বছর গুলোতে বাজেট বাস্তবায়নের হার শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ হলেও গত অর্থ বছরের বাজেট বাস্তবায়নের পরিমান ৮০-৮৫ শতাংশের বেশি হবে না। বাজেটে বরাদ্দকৃত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন দীর্ঘায়িত হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। অন্যদিকে কাঙ্খিত সুফল থেকে মানুষ বঞ্চিত হয় এবং অনেক প্রকল্প প্রলোম্বিত হওয়ায় মানুষের ভোগান্তিও বেড়ে যায়। 
 
প্রকল্পসমূহ সময়মত বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে দূর্বল ব্যবস্থাপনা ও সময়মত টাকা ছাড় করানোকে দায়ী করা হয়। অন্যান্য বছরের মতো এবারের বাজেটেও বিভিন্ন প্রকল্পে ভৌত অবকাঠামোর অংশ বাস্তবায়ন তুলনামূলকভাবে ত্বরান্বিত হয়। যেখানে সামাজিক অবকাঠামোর বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ কম থাকায় বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হয় না। এতে প্রকল্পের কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যায় না। বর্তমান পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নকে শুধুমাত্র আর্থিক বিবেচনা করা হয় অর্থাৎ টাকার অঙ্কে কতটুকু খরচ করা হয়েছে সেটিই মূখ্য হয়ে যায়। বাস্তব কাজের অগ্রগতি এখানে মূখ্য বিষয় নয়। তাছাড়া প্রকল্প সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলেও প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিনা সেটি মূল্যায়ন করা হয় না। প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে যারা মূখ্য ভূমিকা পালন করেন প্রকল্প প্রণয়নে তাদের ভূমিকাই গৌণ। বর্তমান প্রকল্প প্রথায় প্রকল্প চিহ্নিতকরন ও প্রণয়নে যথাযথভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়সমূহ মূল্যায়ন করা হয় না। প্রকল্প প্রণয়নকালে সর্বোচ্চ সুফল পাওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেএে প্রকল্প চিহ্নিতকরনে মনন্ত্রালয় বা সংস্থার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অগ্ররাধিকার করনের ভিত্তিতে করা হয় না।   
 
পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষা শুধুমাত্র পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপর নির্ভর করে না। পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষা সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পের অধিকাংশই নির্ভর করে উন্নয়ন কর্মকান্ডে জড়িত সকল মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কার্যকর্মের উপর। বর্তমান প্রচলিত প্রথায় প্রকল্প প্রণয়নের ছকে পরিবেশ বিষয়টি বিবেচনায় থাকলেও যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হয় না। তাছাড়া প্রকল্প প্রণয়নকালে পরিবেশ সংরক্ষণের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুপারিশগুলো উপেক্ষিত থাকে।
 
পরিবেশ দূষণ এবং তার প্রেক্ষিতে সমস্যা বর্তমান সময়ে সকলেরই একটি দুশ্চিন্তার বিষয়। তবে শুধুমাত্র আইন বা প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবেশ দূষণরোধ করা সম্ভব নয়। উন্নয়ন কাজের সাথে দূষণে একটি নিবিঢ় সম্পর্ক রয়েছে। তাই  দূষণরোধের কাজটি বাজেট ব্যবস্থাপনায় অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।
 
বাজেটে বনভূমি সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা নেই।  কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প এলাকায় বিশাল এলাকাজুড়ে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে কিন্তু এ ব্যাপারে বাজেটে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার উল্লেখ করা হয়নি। বনভূমির এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে এবং হারিয়ে যাওয়া বনভূমি পুনরুদ্ধারে কী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব সে ব্যাপারে বাজেটে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। 
 
২০০৯ সালে নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠিত হয়। এ ফান্ডে ২০০৯-১০ ,২০১০-১১ ও ২০১২-১৩ অর্থছরে প্রতি বছর ৭০০ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪০০ কোটি টাকা , ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থছরে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকা, পরবর্তী প্রতি অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, যত্রতত্র অপ্রয়োজনে অর্থ ছাড়ের বিষয়ে অভিযোগ ওঠায় অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এ ফান্ডে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া কোনোভাবেই যুক্তি সংগত নয়। যাদের ব্যর্থতায় ফান্ড যথাযথভাবে ব্যবহার হয়নি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং এফান্ডে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন।
 
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের  ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বরাদ্দ ১১১৯ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বরাদ্দ ৮৯১ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ১২৬৯ কোটি টাকা। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তরসহ মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্যান্য সংস্থার সম্মিলিত বরাদ্দ ১২৬৯ কোটি টাকা। পরিবেশ ব্যবস্থাপনা-জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এ বরাদ্দ অপ্রতুল। পরিবেশ ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের উপর ন্যস্ত। অধিদপ্তরের বিভাগীয়সহ ২১টি জেলায় অফিস রযেছে এবং ৪৩ জেলায় অফিস নেই। এছাড়াও পরিবেশ ব্যবস্থাপনাসহ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে গবেষণাগারের গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রয়েছে। বিভাগীয়সহ ২১টি জেলা অফিসে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির অভাবে বর্জ্যরেসহ নদ-নদীর পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও রয়েছে জনবলের অভাব। ৪৩ জেলায় অধিদপ্তরের অফিস স্থাপন, প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ এবং প্রতিটি অফিসে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত গবেষণাগার স্থাপনের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রদান।
 
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এ খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদান এবং কর পুনর্বিন্যাস করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।