চকবাজার মর্মান্তিক ঘটনায় দায়ী রাসায়নিক মজুদকারী এবং বাড়ী মালিকের শাস্তি চাই
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ চকবাজারের চুড়িহাট্রায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তার দায় এড়ানোর খেলা চলছে। মর্মান্তিক এই দূঘর্টনার জন্য দায়ী প্রথমত অত্র এলাকার রাসায়নিক ব্যবসায়ী এবং বাড়ীর মালিকগণ যারা দাহ্য পদার্থের গোডাউন ভাড়া দেন। এদের অনেকেই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী। তারা আইনকে তোয়াক্কা না করে আবাসিক এলাকায় ব্যবসা চালিয়ে আসছে। এ চক্র এতই শক্তিশালী যে প্রাথমিকভাবে সিল্ডিন্ডার বিস্ফোরনে অগ্নিকান্ড হয়েছে প্রচার করে অনেকাংশে সফল হয়। এলাকার বিভিন্ন মানুষজনের সাথে আলোচনাকালে ব্যবসায়ীদের অনেকেই রাসায়নিক এবং দাহ্য নানা ধরনের উপকরণের গোডাউন অগ্নিকান্ডের কারণ বলে মানতে নারাজ। অথচ এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে অগ্নিকান্ডের মূল কারণ বিপজ্জনক কারখানা এবং সেইসাথে বিভিন্ন কেমিক্যালের দোকান ও গোড়াউন। এই অপরিমেয় ক্ষতির দায়ে দায়ী কারখানার মালিক এবং বাড়ির মালিককে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সেই সাথে সরকারি দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো কোনভাবেই তাদের দায় এড়াতে পারেন না। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের যেসব কর্মকর্তার গাফেলতিতে আবাসিক এলাকায় এসব দাহ্য পদার্থের  দোকান, কারখানা বা গোড়াউন গড়ে উঠছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। অগ্নিকান্ডের প্রেক্ষিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল সোসাইটির প্রতিনিধিদল ২১ এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পরিদর্শনের প্রেক্ষিতে আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
 
বিদ্যমান আইন এবং রাসায়নিক কারখানা সরানোর জন্য গঠিত কমিটি অনুসারে শিল্প মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, কারখানা পরিদর্শকের অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মতো সংস্থাগুলোর সুস্পষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। গণমাধ্যম সূত্রে দেখা যায়, ২০১১ সালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এজন্য বিসিকের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে আরেকটি কারিগরি কমিটিও গঠন করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। 
 
নিমতলীর দুর্ঘটনার পর তালিকা করে ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার এবং কেরানীগঞ্জে ‘কেমিক্যাল পল্লী’ গড়ার উদ্যোগ গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু আজো কোন অগ্রগতি আসেনি। ২০১৭ সালে ফায়ার সার্ভিস এক জরিপের মাধ্যমে ৪০০ বাড়িতে রাসায়নিক কারখানা শনাক্ত করে এবং এ তালিকা সিটি কর্পোরেশনকে প্রদান করে। কিন্তু এই দীর্ঘসময়ে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ হতে এ সকল কারখানা ও গুদাম সরাতে বা বন্ধ করতে কোন ধরনের ফলপ্রসু উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সাধারণ পর্যবেক্ষণে মনে হয় পুরানা ঢাকার অধিকাংশ বাড়িতে ছোট বড় বিভিন্ন কারখানা রয়েছে। কোন কোন বা বাড়িতে ২-৩টি গুড়াউন বা কারখানা রয়েছে। তাতে সাধারণভাবে ধারণা করা যায় যে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২০/৩০ হাজার কারখানা রয়েছে পুরান ঢাকায়।
 
শহরে যে কোন ব্যবসার জন্য সিটি কর্পোরেশনের লাইন্সেস নিতে হয়, রাসায়নিক আমদানী ও মজুতের ক্ষেত্রে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন, কারখানা স্থাপনে ফায়ার সার্ভিস এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন। এছাড়া কারাখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে জনবল ও বাজেটে কোন ঘাটতি আছে রয়েছে কি না, সংস্থাগুলোর বিগত দিনে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা বা অসহযোগিতা করেছে কি না অথবা ব্যবসায়ীরা সরকারী সংস্থাগুলোর ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করছে কি না, তাও খুজে দেখা জরুরি।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল সোসাইটির সাবেক সভাপতি ইউজিসি প্রফেসর মুহিবুর রহমান, পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, পবার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল, নির্বাহী সদস্য মো: সেলিম, বিসিএইচআরডির নির্বাহী পরিচালক মো: মাহবুল হক প্রমুখ। 
 
সংবাদ সম্মেলন থেকে নিন্মোক্ত সুপারিশ করা হয়- 
১) চকবাজারের অগ্নিকান্ডে চিকিৎসারতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সহায়তা প্রদান এবং নিহত পরিবারকে সবধরণের পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান এ ঘটনার জন্য দায়ীদের নিকট হতে ক্ষতিপুরণ আদায় করা। 
২) আইন লঙ্ঘন করে রাসায়নিক কারখানা এবং অন্যান্য দাহ্য উপকরনের গোডাউন স্থাপন এবং ভাড়া প্রদানকারী বাড়ীর মালিক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা। 
৩) বিদ্যমান আইন এবং রাসায়নিক কারখানা সরানোর জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, কারখানা পরিদর্শকের অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মতো সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা বা অসহযোগিতা করেছে কি না অথবা ব্যবসায়ীরা সরকারী সংস্থাগুলোর ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করছে কি না, তা বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন ও প্রতিবেদন প্রকাশ। 
৪) রাজউক যে উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য একটি ভবনের নক্সা অনুমোদন করে, ভবনটি সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা সেটি মনিটারিং করা ও বিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
৫) পুরান ঢাকার সকল রাসায়নিক কারখানা, রাসায়নিক এবং অন্যান্য দাহ্য উপকরনের গোডাউনের তালিকা হালনাগাদ করা। 
৬) বিপদজনক কারখানা ও গোডাউন আগামী ১ মাসের মধ্যে সরকারের তত্বাবধানে অস্থায়ী শেড করে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর। 
৭) অনধিক ৬ মাসের মধ্যে সরকার নির্ধারিত স্থানে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব খরচ নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে সকল রাসায়নিক এবং দাহ্য নানা ধরনের উপকরণের গোডাউন ও কারখানা স্থানান্তর। এ সকল স্থাপনা যেন পরিবেশ দূষণ এবং বিপজনক অবস্থা সৃষ্টি করতে না পারে যে জন্য ব্যবসায়ীদের অবকাঠামো এবং স্থাপনার উপর সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর নজরদারি রাখা। 
৮) পুরানা ঢাকার সরু রাস্তায় চলাচলের উপযোগী ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ গাড়ী ক্রয় এবং শুধূ পানি দিয়ে নয় ক্যামিক্যাল ও ইলেকট্রিক আগুন নেভানোর আধুনিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা করা। 
৯) পানির সমস্যা সমাধানের রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফায়ার হাইড্রেন্ট (জরুরি অবস্থায় পানি পাওয়ার ব্যবস্থা) স্থাপন করা। 
১০) অবিলম্বে রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন, বিপনন, গুদামজাতকরণ ও পরিবহনের জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ণ ও তার বাস্তবায়ন করা। 
১১) কেবল মাত্র একজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত রসায়ন বিষয়ে ন্যুনতম জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তির তত্বাবধান রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন, বিপনন, গুদামজাতকরণ এর জন্য বাধ্যতামূলক করা। 
১২) রাসায়নিক কারখানায় কর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক। 
১৩) রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা। 
১৪) লোকলয়ে রাসায়নিক দ্রব্যাদির গুদামজাত করণ, বিপনন ও উৎপাদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হোক। 
১৫) শহরতলীতে একটি পৃথক শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা করে সব ধরনের রাসানিক দ্রব্যের ফ্যাক্টরী ও গুদাম শহর থেকে সেখানে স্থানান্তর করা হোক। 
১৬) পুরান ঢাকায় বিল্ডিং কোড এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হোক।