পরীক্ষার নিমিত্ত দুধের নমুনা সংগ্রহে দূর্নীতিমুক্ত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ কর

মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক নির্দিষ্ট করে দেওয়া ল্যাবরেটরিতে সরবরাহ করবার জন্য নমুনা সংগ্রহ যেন সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুযায়ী হয়। আমরা আশংকা করছি নমুনা সরবরাহ করার ক্ষেত্রে দূর্নীতি হতে পারে। খোলা বাজার থেকে (Random sampling) পদ্ধতিতে নমুনা নিতে হবে। কোন মতেই ঘোষিত পূর্বনির্ধারিত স্থান থেকে সংগৃহীত অথবা কোম্পানির সরবরাহ করা নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা চলবে না। নমুনা সংগ্রহের সময় কয়েক প্রস্থ নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। আদালত কর্তৃক নির্দিষ্ট ল্যাবে এক প্রস্থ নমুনা পাঠাতে হবে। আরেক প্রস্থ নমুনা দেশের বাইরে WHO-এর স্বীকৃত রেফারেন্স ল্যাবে পাঠাতে হবে। এতে জনমনে তৈরি হওয়া আশংকা ও আতংক দূর হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), ডাব্লিঊবিবি ট্রাস্ট, ডক্টরস ফর হেলথ্ এন্ড এনভায়রনমেন্ট, জনউদ্যোগ, বিসিএইচআরডি, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ, গ্রীনফোর্স, সুবন্ধনসহ বিভিন্ন সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে “ঢাবি অধ্যাপকের পাস্তুরিত দুধ নিয়ে গবেষণা: জনস্বার্থে করণীয়” শীর্ষক আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধে ডা: লেলিন চৌধুরী উপরোক্ত দাবী রাখেন। আবু নাসের খান, চেয়ারম্যান, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন(পবা) এর সভাপতিত্বে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত অদ্যকার (১৭ জুলাই ২০১৯) আলোচনা সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মো: আবু সাঈদ, প্রেসিডেন্ট, ডক্টরস ফর হেলথ্ এন্ড এনভায়রনমেন্ট, গাউস পিয়ারী, পরিচালক, ডাব্লিঊবিবি ট্রাস্ট, তারিক হোসেন, সমন্বয়কারী, জনউদ্যোগ, মাহাবুবুল হক, প্রেসিডেন্ট, বিসিএইচআরডি, মেজবাহ্ উদ্দিন সুমন, সমন্বয়কারী, গ্রীনফোর্স, শেখ ফরিদ, সক্রিয়বাদী, রুনু আলী, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, ইঞ্জি: আনোয়ার হোসেন, সভাপতি, নিরাপদ পানি আন্দোলন।

দুধ একটি অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য। শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এই খাদ্যটির গুরুত্ব অপরিসীম। এরকম প্রয়োজনের তাগিদেই তরল কাচা দুধকে পাস্তুরিত করার পর প্যাকেটজাত করে সরবরাহ করার আধুনিক পদ্ধতি গড়ে উঠেছে। আধুনিক যুগে পুরো ব্যাপারটাই এখন শিল্পের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে। খাদ্যের সাথে জীবন ও সুস্থতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। তাই বানিজ্যিক ভাবে লেনদেন হয় এমন সকল খাদ্যের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মান নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপি এই মান নির্ধারণের কাজটি করে থাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশক সূচি অনুযায়ী প্রতিটি দেশ নিজস্ব মান তৈরি করতে পারে। অথবা সরাসরি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অনুসরণ করতে পারে। তরল পাস্তুরিত দুধের জন্য আমাদের একটি দেশীয় মানদ- রয়েছে।

বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ এবং খাদ্য দূষণ নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে প্রায় সিকি শতাব্দী যাবৎ। যার ফলশ্রুতিতে এদেশে পরিবেশ রক্ষা এবং নিরাপদ খাদ্যের জন্য আন্দোলন গড়ে উঠে। পরিবেশ দূষণ এবং খাদ্য দূষণ মুলত একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া। বিশেষ করে ফসল, শাকসবজি ও ফলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বিচারবিবেচনাহীন এবং নির্দেশনা বহির্ভূত ব্যবহারের দরুন মানুষ এবং অন্য প্রাণী দ্রুত এসব বিষ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। গবাদিপশু ও হাঁসমুরগির উপর প্রয়োগকৃত অ্যান্টিবায়োটিক ও হরমোন পরিবেশ ও খাদ্যে মিশে মানবশরীরে নানা জাতীয় ক্ষতি ও রোগের সৃষ্টি করে। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে পরিবেশবাদী এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করতে শুরু করেন প্যাকেটজাত তরল পাস্তুরিত দুধ মানসম্মত নয় এবং এতে নানা ক্ষতিকর পদার্থ থাকতে পারে। ক্রমশ বিষয়টি গণদাবিতে রূপান্তর হয়।

সরকারি জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান বাজারে থাকা দুধের নমুনা পরীক্ষা করে। সংস্থাটি তাদের রিপোর্ট ১০.০২.১৯ -এ প্রকাশ করে। তারা প্যাকটজাত দুধের ৩১টি নমুনার ৬৬ -৮০%-এ অনুজীব বা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি শনাক্ত করে। ৩০% নমুনায় গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে টেট্রাসাইক্লিন নামের অ্যান্টিবায়োটিক পায়। ১টি নমুনায় সীসা এবং কয়েকটিতে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন ও এনরোফ্লোক্সাসিন নামের অ্যান্টিবায়োটিক শনাক্ত করে। এর আগে ১৬.০৫ ১৮-তে রপফফৎ,ন তাদের রিপোর্টে বলেছিল পাস্তুরিত দুধের ৭৭% নমুনায় উচ্চমাত্রার ব্যাকটেরিয়া,৩৭% নমুনায় কলিফর্ম এবং ১৫%-এ মলবাহিত কলিফর্ম বা ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। গতমাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের প্রধান প্রফেসর আ ব ম ফারুক তার একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। তিনি ঢাবির ফার্মেসি বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক। তিনি বাজার থেকে কয়েকটি পাস্তুরিত দুধের নমুনা সংগ্রহ করেন। সেগুলো পরীক্ষা করে তিনি তাতে লিভোফ্লোক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও অ্যাজিথ্রোমাসিন নামের অ্যান্টিবায়োটিক এবং ডিটারজেন্টের উপস্থিতি পান। তিনি তার পরীক্ষার ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করেন। এতে বিভিন্ন কোম্পানীগুলো এমনকি সরকারী দপ্তর অসৌজন্যমূলকভাবে অধ্যাপক আ. ব. ম. ফারুক তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন।

আমরা মনে করি একটি গবেষণালব্ধ ফলাফলের জবাব আরেকটি গবেষণা দিয়েই দেওয়া যৌক্তিক এবং স্বীকৃত পদ্ধতি। মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিলো জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে প্রফেসর ফারুকের গবেষণার জন্য তাকে সাধুবাদ জানানো। এরপর জনমনে তৈরি হওয়া সংশয় দূরীকরণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনকৃত রেফারেন্স ল্যাবরেটরি থেকে অভিযুক্ত কোম্পানির দুধ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করানো। সেই ফলাফল প্রকাশ করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া।

অধ্যাপক আ. ব. ম. ফারুক বলেন, পাস্তরিত ও অপাস্তরিত দুধে মানবদেহের চিকিৎসায় ব্যবহ্নত এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি সনাক্তের প্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্য রক্ষার জরুরী প্রয়োজন জনস্বার্থে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাসমূহ যেমন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচ) ইত্যাদি ল্যাবরেটরিগুলোতে যেন এখন থেকে নিয়মিতভাবেই দুধে এন্টিবায়োটিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। বিএসটিআইয়ের দেড় যুগের পুরানো দুধের স্ট্যান্ডাডের্ (Bangladesh Standard, BDS 1702. 2002) বর্তমানের নয়টি পরীক্ষার সাথে কমপক্ষে এন্টিবায়োটিক ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতি পরীক্ষার মতো দু‘টি পরীক্ষা অন্তর্ভূক্ত করে দুধের এই স্ট্যান্ডাডর্কে যুগোপযোগী করার জন্যও আহবান জানান।

একটি অসাধু আমদানীকৃত নম্নেমানের গুড়া দুধ দিয়ে তৈরী করছে তরল দুধ। এমনকি ডিটারজেন্টসহ বিভিন্ন কেমিকেল দিয়ে দুধ তৈরী করে বিভিন্ন কোম্পানীতে কম মূল্যে সাপ্লাই দিচ্ছে এমন প্রতিবেদন প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এই অসাধু চক্রের কারনে প্রকৃত চাষীরা বাজারের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না ফলে আর্থিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বিকাশমান শিল্পকে বাচিয়ে রাখেতে বিদেশী দুধ নয়, দেশী দুধই নিরাপদ করতে হবে।