খাদ্যকে ভেজালমুক্ত করা গেলে ক্যান্সার কমপক্ষে অর্ধেকে নেমে আসবে

দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিষ ও ভেজালমুক্ত এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রকে আমরা এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে দেখছি না। আমরা বঞ্চিত হচ্ছি বিষ ও ভোজালমুক্ত এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য পাওয়ার অধিকার থেকে। এখন এমন কোন খাদ্যদ্রব্য নেই যা মানসম্পন্ন এবং যাতে ভেজাল ও মারাত্মক ক্ষতিকর বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশানো নেই। উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ প্রত্যেকটি স্তরেই এর ছড়াছড়ি রয়েছে। সহজপ্রাপ্যতা, আইন প্রয়োগ ও যথাযথ নজরদারির অভাবে এসব ঘটেই চলেছে, যাতে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে। শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ- মাংস, দুধ, মিষ্টি, প্যাকেটজাত খাদ্য ও পানীয়সহ প্রায় সব ধরনের খাবারে ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। ফল ও তরিতরকারি দ্রুত বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম হরমোন গ্রোথ, কীট পতঙ্গ প্রতিরোধে নিষিদ্ধ বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। ফল কৃত্তিম উপায়ে পাঁকাতে ব্যাপকভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, কপার সালফেট, কার্বনের ধোঁয়া, পটাশের লিকুইড সলিউশন প্রয়োগ করা হয়। মুড়িতে ইউরিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত বোতল ও প্যাকেটজাত খাদ্য যেমন শরবত, ফলের রস, জ্যাম-জেলীতে বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর রং ও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মিষ্টিতে কৃত্রিম মিষ্টিদায়ক এবং কাপড়ের রং প্রয়োগ করা হয়।

রমজান মাসে ইফতারিতে যেসব খাদ্যপণ্যের সবচেয়ে বেশী চাহিদা সেগুলো হলো শরবত, খেজুর, ছোলা, মুড়ি, বেসন, ডাল, তেল, চিনি, দুধ, সেমাই, মুরগী, মাছ, দেশী-বিদেশী ফল, শসা, টমেটো, বেগুন, কাঁচা মরিচ, লেবু, আটা, ময়দা, ইত্যাদি। রমজানের বাজার ধরার লক্ষ্যে এসব খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও মজুত করতে বিষাক্ত কেমিক্যাল, কৃত্রিম হরমোন গ্রোথ, মানুষের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হচ্ছে। অসাধু শিল্পপতি, উৎপাদনকারী, কৃষক, ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, মজুতদার, পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা অধিক মুনাফার লোভে খাদপণ্যে ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক ও ভেজালের মিশ্রণ করে থাকে। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর রেল ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, মোটর যান, নৌ যান ও কলকারখানার পোড়া তেল ও মবিল মিশ্রিত তেল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ইফতার সামগ্রী ভাজা হয়। এছাড়াও একই তেল বার বার ব্যবহার করার ফলে তা বিষাক্ত হয়ে যায়। রাসায়নিক রং ও বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে ভোজ্য তেল তৈরী করা হয়। সেমাইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই উৎপাদন এবং তাতে রাসাযনিক দ্রব্য মিশানো হচ্ছে। যা আমাদেরকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং আগামী প্রজন্ম বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইফতারিসহ সকল খাদ্য বিষ ও ভেজালমুক্ত করতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র উদ্যোগে আজ ১৭ মে ২০১৯, শুক্রবার, সকাল ১০.৩০টায়, পবা কার্যালয়ে “বিষাক্ত খাদ্য : সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ও করণীয়”-শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে উক্ত গোলটেবিল বৈঠকের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান, মূখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাবি’র ঔষুধ প্রযুক্তি বিভাগ-এর অধ্যাপক আ.ব.ম. ফারুক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ-এর ডা. মো. আবু সাইদ, নাসফের সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী, বানিপা’র সভাপতি প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন, বিজিআরএম-এর সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. গোলাম হায়দার, হিল-এর সভাপতি মো. জেবুন নেসা প্রমুখ ।

ঢাবি’র ঔষুধ প্রযুক্তি বিভাগ-এর অধ্যাপক আ.ব.ম. ফারুক বলেন খাদ্যকে ভেজালমুক্ত করা গেলে ক্যান্সার কমপক্ষে অর্ধেকে নেমে আসত । বক্তারা বলেন, নানা ধরনের বিষাক্ত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুতকৃত নিম্নমানের খাদ্যের কারণে আগামী প্রজন্ম বিভিন্ন গুরুতর অসুখের ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। দীর্ঘদিন বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে গর্ভবতী মা ও তার পেটের ভ্রুনের ক্ষতি হয়, সন্তানও ক্যান্সার, কিডনীসহ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। গর্ভবতী নারীরা জন্ম দিতে পারে বিকলাঙ্গ শিশু, গর্ভস্থ শিশু স্বল্পবুদ্ধি সম্পন্ন ও প্রতিবন্ধী হওয়ার আশংকাও থাকে। এসব খাবারে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিশুরা। কিডনী ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী দেশে দুই কোটির বেশী মানুষ কিডনী রোগে আক্রান্ত এবং রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের ফলেই কিডনী রোগ হচ্ছে। প্রতিমাসে ক্যান্সার, কিডনী ও লিভার রোগী দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। খাদ্যের সক্সেগ বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ গ্রহণের পর তা নিঃশেষ না হয়ে দেহের ভিতর দীর্ঘদিন জমা থাকে। ফলে এ বিষক্রিয়া বংশ থেকে বংশে স্থানান্তর হয়।