কেন বস্তি পুড়ে! খতিয়ে দেখতে কমিশন গঠন করুন

বস্তি কেন পুড়ে তা খতিয়ে দেখতে ও নিম্নে আয়ের মানুষদের আবাসনের জন্য জাতীয় বস্তি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি জননেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য। আজ প্রেসক্লাবের ভিআইডি লাউঞ্জে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের উদ্যোগে পবা চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সংলাপে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, জনগণ বারবার ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে ধোকা খায়। বস্তিবাসীদের জন্য মহামান্য হাইকোর্টেও রোল জারি করা থাকলেও প্রতিবছর বস্তিতে আগুণ লাগে আর বস্তি উচ্ছেদ হয়। কেন বস্তি পুড়ে তা খতিয়ে দেখা জরুরি। একটি পৃথক কমিশন গঠন করে সকল অগ্নিকান্ডের কারণ অনুধাবন করে বস্তিবাসীদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ আবাসন কর্তৃপক্ষ তৈরি করে বস্তিবাসীদের ন্যায্য আবাসন অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বস্তিতে আগুণ লাগে না লাগিয়ে দেয়া হয় তা খতিয়ে দেখতে হবে এবং বস্তি নিয়ে রাষ্ট্রের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। মনে রাখতে হবে বস্তিবাসীরা মানুষ আর তাদের অবদানের উপর এই রাষ্ট্র ও দেশ টিকে আছে। 
সংলাপে বক্তারা আরো বলেন, বস্তিবাসী আজ সমাজে গালি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু ঢাকা শহরের নিম্নে আয়ের এই মানুষরা যদি একদিন কাজ না করেন তবে শহর অচল হয়ে যাবে। অথচ কি অদ্ভুত ভাবে নিয়মিত বিরতীতে আমাদের এই বস্তিগুলোকে পুড়তে দেখতে হয়। বক্তাবরা সকল অগ্নিকান্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের ও ক্ষতিপূরণের প্রদানের দাবি জানান।
সংলাপে বস্তিবাসী নেতারা বলেন, আমরা ভিক্ষা চাই না। আমরা চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বস্তিবাসীদের জন্য যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়ন করা হোক। আর এই বস্তিবাসী ও নিম্নে আয়ের মানুষরাই যেনো আবাসন অধিকার পায়।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ধারনা পত্র উপস্থাপন করেন প্রকল্প সমন্বয়ক মো: জাহাঙ্গীর আলম, সংলাপে আরো বক্তব্য রাখেন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা: ওয়াজেদুল ইসলাম খান, ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেবাশীষ কুমার কুন্ডু, পবার সাধারণ সম্পাদক প্রৌকশলী আব্দুস সোবহান, গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ, আওয়ামী বাস্তুহারা লীগের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ হালদার, বস্তিবাসী নেতা কুলসুম বেগম, রাফেজা বেগম ও প্রবাশ ফেরত নুরজাহান বেগম প্রমূখ।
আলোচকরা আরো বলেন, ২০০৫ সালের আরবান স্টাডিস এর হিসাব মতে মোট বস্তিবাসীর সংখ্যা ছিল ৩৪,২০,৫২১ জন যা ঢাকার মোট জনসংখ্যার ৩৭.৪%। জনবহুল ঢাকা শহরে চল্লিশ লক্ষের অধিক বস্তিবাসী মানুষ করে। নগর এবং গ্রামের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানাবিধ প্রাকৃতিক আপদ যেমন; বন্যা, নদীভাঙ্গন, জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণীঝড়, খরা, শৈতপ্রবাহ, লবনাক্ততা কারণে মানুষ জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে ভীড় করছে। ফলে সহজ লভ্যতার কারণে তাদের অধিকাংশেরই জায়গা হচ্ছে শহরের অপরিকল্পিত এবং অপরিচ্ছন্ন বস্তিতে ও ফুটপাতের খোলা জায়গায়। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব গ্রামের পাশাপাশি শহরকেও ক্ষতিগ্রস্থ করে তুলছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগের এই প্রভাব শহরের বস্তিবাসীর জীবনকে আরও অসহনীয় করে তুলছে। 
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন আঞ্চলের বস্তিগুলোতে প্রায়ই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। সহায় সম্বলের পাশাপাশি এই সব অগ্নিকান্ড কেড়ে নেয় প্রাণও। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যানুযায়ী গত বছর ২০১৮ সালে সারাদেশে ১৬৫ টি অগ্নিকান্ড ঘটে, যার মধ্যে ঢাকাতে ঘটে ৩৩ টি অগ্নিকান্ড। গড়ে প্রতি ৩ দিন অন্তর দেশের কোথাও না কোথাও বস্তিতে অগ্নিকান্ড ঘটে। এই সব অগ্নিকান্ডে আনুমানিক ক্ষতির পরিমান প্রায় ৯৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে আজ পর্যন্ত সারা দেশে ২৮ টি বস্তিতে অগ্নিকান্ড ঘটেছে এবং সম্পদ হানির পাশাপাশি এই ঘটনায় ১৮ জন নারী-শিশু-বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনের ঝিলপাড়ের চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ অগিকান্ডে আনুমানিক ৫০০০ পরিবারের স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রতিটি পরিবারের গড়ে ৩০,০০০ টাকার সম্পদ নষ্ট হলে গড়ে ৫০০০ টি পরিবারের গড়ে মোট ক্ষতির পরিমান প্রায় ১৫,০০,০০০০০.০০ (১৫ কোটি) টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে খাওয়া ও থাকার আপাত ব্যবস্থা করলেও সব হারিয়ে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। 
বস্তিতে বারবার অগ্নিকান্ডের কারণ কি। বস্তির অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থদের দাবী, সরকারী জায়গা দখল নিতে সুবিধাভোগীদের দুর্বূত্তরা বস্তিতে আগুন লাগায়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সেই সরকারের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মীর প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসীরা অগ্নিকান্ড সংঘটন করে। প্রতিটি ঘটনার পরই গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু তদন্তের পরও বস্তিবাসীদের অভিযোগের সত্যতা পায় না সংশ্লিষ্টরা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে বস্তিতে বারবার কেন আগুন লাগে? বস্তির আগুন কি দূর্ঘটনা নাকি নাশকতা?
২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে আওয়ামীলীগের সভাপ্রধান,গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কামরাঙ্গীচরে এক নির্বাচনী জনসভায় ঘোষনা করেন; ”কেবল বড়লোকেরাই ফ্লাটে থাকবে এবং বহুতল ভবনে থাকার সুয়োগ পাবে, তা হবে না। মধ্য ও নি¤œ আয়ের মানুষেরা যাতে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে ফ্লাটে থাকতে পারে আমরা এই সুবিধা করে দিচ্ছি। আমরা এই এলাকার ন্মিœ আয়ের মানুষের জন্য ১০ হাজার ফ্লাট তৈরীর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। অনুরুপভাবে ১৯ আগষ্ট ২০১৮ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক ভাষনে বলেছেন; বস্তিবাসীরা ২০ তলা ফ্লাটে থাকবে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে বিত্তবানরাও যেমন থাকবে; তেমনি বস্তিবাসীরাও থাকবে। কারণ তারাও তো মানুষ। উচ্চবিত্তদের জন্য গরীব মানুষের দরকার আছে।
বেসরকারী গবেষণা সংস্থা বারসিকের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে ঢাকা শহরের অধিকাংশ বস্তি ব্যক্তিমালিকাধীন, বাকীগুলো সরকারী জায়গায় গড়ে উঠেছে এবং বেশ কিছু মানুষ ভাসমান অবস্থায় থেকে জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সব বস্তিগুলোর অধিকাংশ নগরের নদী, খাল, ও জলাভ’মির কাছে এবং শহরের প্রান্তীক এলাকায় অবস্থিত। এইসব বস্তির পরিবেশ অত্যান্ত অপরিচ্ছন্ন, অমানবিক ও ঘিঞ্জি। এখানে পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা অপ্রতুল, নেই বর্জ্র ব্যবস্থাপণার কোন সঠিক পরিকল্পনা। গবেষণায় দেখা গেছে বস্তিতে প্রতিটি ল্যাট্রিন /টয়লেট গড়ে ১৫০-২০০ জন মানুষ ব্যবহার করে যা কোন ভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এছাড়া তারা একটি বাতির জন্য দেন ২৫০ টাকা। দুইটি বাতি একটি ফ্যান ব্যবহার করলে মাসিক ভাড়া দেন ৭৫০ টাকা। মৌলিক অধিকারের মূখে ছাই মেখে সরকারী পানি বিদ্যুৎ, গ্যাস কিনতে হয় বাজার মূল্যের চাইতে অনেক বেশী দামে। প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া তাদের অল্প আয়,নিম্নে মানের তৈলযুক্ত খাবার গ্রহণ, অসচেতনতা, চিকিৎসার অভাব এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার কারণে দ্রুতই তাদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। ফলে তারা ডায়রিয়া, কলেরা, জ¦র, কাঁশি, গ্যাস্টিক, হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের আয়ের অধিকাংশ টাকা খরচ করে ফেলে। 
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে বস্তিবাসীরা যে আয়তনের জন্য ২৫০০-৩০০০ টাকা মাসিক ভাড়া দেয়, আয়তন ও অন্যান্য সুবিধা বিবেচনায় তা বনানী-গুলশানের এপার্টমেন্টের ভাড়ার চেয়েও তারা বেশী ভাড়া দেয়। ঢাকার প্রায় সবকটি বস্তিতেই স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, পয়:নিষ্কাশন এবং বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা নেই বরং আছে বিচারহীনতা এবং শোষন। অন্যদিকে উচ্ছেদ সমস্যা বস্তিবাসী মানুষের আরেকটি আতংকের নাম। সম্প্রতি ঢাকার ভাষানটেকে থেকে প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে তাদের অমানবিক ভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা অমানবিক কাজ। বস্তি নিয়ে বারসিকের গবেষণায় ২৩ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন উচ্ছেদের কারণে তারা বস্তি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। এই শহরের বস্তিবাসীরা হাজারো পেশায় যুক্ত থেকে শহরটাকে সচল করে রেখেছেন কিন্তু রাষ্ট্র এই দরিদ্র জনগোষ্ঠির জীবনকে সচল রাখার জন্য উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপই নেয়নি। 
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল বস্তিবাসীদের জন্য আবাসন নিশ্চিত করার কথা বিভিন্ন সময় বলেছেন। যদিও বস্তিবাসীদের জন্য সরকারীভাবে তৈরী করা প্রথম ভাষানটেক আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ব্যবস্থাপনায় সরকার পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তারপরও সরকারীভাবে আরো বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করি। কারণ ওয়াল্ড আরবান ফোরামের মুল কথাই হলোই ” সবার জন্য নগর, সবাইকে নিয়েই নগর। সুতারাং নগরের বস্তিবাসীসহ সকল শ্রেনী পেশার মানুষের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা সরকারীভাবেই করতে হবে।
আমাদের দাবীসমূহ্;
১. মিরপুর ঝিলপাড়ের চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ অগিকান্ডে আনুমানিক ৫০০০ পরিবারের ক্ষতির পরিমান ১৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে।
২. উক্ত স্থানে তাদের দ্রুত পূনবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. নগর বস্তিবাসীদের জন্য নিরাপদ ও স্থায়ী অবাসনের ব্যবস্থা সরকারী ভাবে করতে হবে।
৪. বস্তিবাসীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দ্রুত আবাসন তৈরীর কাজ শুরু করতে হবে।
৫. বস্তিবাসীদের জন্য নির্মিত ফ্লাট প্রাপ্তির প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সহজ লভ্য করতে হবে।
৬. ফ্লাটের দাম বস্তিবাসীদের সাধ্যের মধ্যে রাখতে হবে।
৭. দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় নগর দরিদ্রের জন্য বিশেষ ঝুকি ভাতা /প্রনোদনা দিতে হবে।
৮. নগর দরিদ্রের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৯. জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনায় নগরের দুর্যোগ ও ঝুঁকিকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে যুক্ত করতে হবে।
১০. বড় বস্তির কাছে সার্বক্ষনিক ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট রাখতে হবে।
১১. প্রতিটি বস্তিতে প্রশিক্ষিত ভলেন্টিয়ার তৈরী করতে হবে।
১২. প্রতিটি শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।