সঠিক ব্যবস্থাপনায় হাওরের প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়বে

#সঠিক ব্যবস্থাপনায় হাওরের প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়বে

আমাদের জলাভূমি, জলাভূমি অঞ্চলের জনগোষ্ঠী, পেশাজীবী জনগণ, উন্নয়নের রূপ বদলাচ্ছে। জলাভূমি ব্যবস্থাপনায় অনেক দুর্নীতি ও বাধা আছে। প্রকৃত পেশাজীবী জেলেরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দিনদিন প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ ও বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। কেবলমাত্র ধনীদের মত বিল ইজারা দেয়া বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত মৎস্যজীবীর নামে অপ্রকৃত মৎস্যজীবীর মাধ্যমে জলাভূমি ও মৎস্য সম্পদ নিয়ন্ত্রণ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় হাওরের প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়বে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বক্তারা।
আজ জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক কর্তৃক আয়োজিত হাওরের ইজারা প্রথা ও মৎস্য ব্যবস্থাপনা শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় সভা প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, জেলেসহ হাওরাঞ্চলের মানুষের কথা আমাদের বেশি বেশি শোনা দরকার। হাওরের প্রকৃত অবস্থাটি হৃদয় দিয়ে অনুভব করা দরকার। যত বেশি আমরা আলোচনা করবো তত বেশি জলাভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য উপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারবো।”

পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও গবেষক পাভেল পার্থের সঞ্চাচলায় গোলটেবিলে আলোচনা করেন সাবেক সাংসদ ছবি বিশ^াস, মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক কাজী শামস আফরোজ,ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক নেতা কুদ্দস আফরাদ, বিআইডবিøউটি এর সাবেক পরিচালক সৈয়দ মনোয়ার হোসেন, হাওর গবেষক হালিম দাদ খান, পবা’র সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল, এ্যাড সুব্রত চৌধুরী, মেনন চৌধুরী, শাহরিয়ার চৌধুরী বিপ্লব, নেত্রকোনায় জানমা মৎস্যজীবী সমিতির নেতা যোগেশ চন্দ্র বর্মণ প্রমূখ। গোলটেবিল আলোচনায় ধারণাপত্র উত্থাপন করেন বারসিকের পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ^াস।
গোলটেবিলে বক্তারা মৎস্য সম্পদ বাঁচাতে কৃষিখেতে রাসায়নিকের ব্যবস্থা বন্ধ করতেও আহবান জানান। হাওরাঞ্চলের বোমা মেশিন, অবৈধ বালু উত্তোলন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো, উজানে অপরিকল্পিত খনন বন্ধের আহবান জানান। তারা আরো বলেন, প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন কমলেও চাষের মাছ কিন্তু বেড়েছে। কিন্তু সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার দ্বারা মাছের পোনা না ছেড়েও প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।

বক্তারা আরো বলেন, একটি সামগ্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক উৎস এবং প্রাকৃতিক সম্পদগুলো নিদারুণভাবে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়। দু:খনজকভাবে দেশের বৈচিত্র্যময় জলাভূমিগুলো তাদের নাম-পরিচয় এবং বিশেষ বাস্তুসংস্থানের ধরন হারিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জলমহাল’ হিসেবে পরিচিত হতে থাকে বা পরিচয় করানো হয়। আর এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনাগত দৃষ্টিভঙ্গি হলো সেই জলাভূমিতে বাজারনির্ভর মৎস্যজাত পণ্যের হিসাব-নিকাশ। আর তাই জলাভূমির সাথে জড়িত স্থানীয় পেশাজীবী জনগণ থেকে শুরু করে চারপাশের বৈচিত্র্যময় সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করে জলাভূমিকে দেখা হয় মূলত বাণিজ্যকভাবে মাছচাষের জায়গা হিসেবে, যেন এগুলো এক বৃহৎ কোনো মৎস্যখামার। বেসরকারি সংগঠন আইইউসিএনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়: দেশের ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে ১২ প্রজাতির মাছ চরম বিপন্ন, ২৮ প্রজাতির মাছ বিপন্ন ও ১৪ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এই প্রতিবেদন থেকেই দেশের মিঠা পানির মাছ বৈচিত্র্য পরিস্থিতি অনুমান করা যায়। জলাভূমি নিয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। হাওরাঞ্চলের জলাভূমিগুলির প্রতিটির বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং এর সাথে হাওরবাসীর নানাবিধ সম্পর্ক আছে। একে কেবলমাত্র জলাভূমি ব্যবস্থাপনার নামে ধনী ও প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিয়ে বৃহৎ মৎস্যখামারে পরিণত করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে।

বর্তমান সরকার মৎস্যজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মৎস্যজীবীদের পরিচয়পত্র তথা মৎস্যজীবী কার্ড প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যেন প্রকৃত মৎস্যজীবীরা জলমহালসহ সরকারী সুযোগ সুবিধায় তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। মৎস্যজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী এই উদ্যোগটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১১ সালে বারসিকের এক সমীক্ষা থেকে দেয়া যায়, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলায় মোট ৩৭৬টি প্রকৃত মৎস্যজীবী পরিবার থাকলেও উপজেলা মৎস্য বিভাগের তত্ববধানে এই উপজেলায় মোট ৩৫৮৬ জনকে প্রকৃত মৎস্যজীবী হিসেবে মৎস্য কার্য প্রদান করা হয়। বর্তমান সময়ে জলশয়ে প্রকৃত জেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় আন্তরায় হচ্ছে অমৎস্যজীবীদের মৎস্যজীবী বানানো। এটা থেকে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে, প্রশাসন ও স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামো কিভাবে সরকারী নিয়ম নীতিকে নিয়ন্ত্রন করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে ক্ষমতার বলে অমৎস্যজীবীরা মৎস্যজীবী হয় সে একই ক্ষমতার প্রভাবে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা জলাশয়ে তাদের অধিকার হারায়। যদিও সরকারি নীতিমালায় প্রকৃত মৎস্যজীবীদের অধিকারের কথা সুষ্টভাবে বলা হয়েছে কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জলমহালে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি।

বর্তমানে হাওরের জলমহালগুলোতে মাছ বৃদ্ধির জন্য বাইরের খাবার ও ঔষুধ (কীটনাশক) প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রাকৃতিক জলমহাল ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে মৎস্য উৎপাদন আর খামারভিত্তিক মৎস্য চাষ এক বিষয় নয়। ইজারাদারগণও বিভিন্ন পরিবেশ বিনাসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মৎস্য খামারিরা যেমন পুকুর পরিস্কার করার নামে রোটানেন গ্রæপের বিষ প্রয়োগ করে পুকুরের সকল জলজ প্রাণীকে হত্যা করে, অনুরুপভাবে হাওরের ইজারাদাররা মৌসুম শেষে মাছ ধরার সময় জলাশয়ে রোটানেন গ্রæপের বিষ প্রয়োগ করে। যেন অক্সিজেনের অভাবে জলাশয়ের সকল মাছ পানির উপরিভাগে চলে আসে এবং সহজেই ধরা যায়। এর ফলে জলাশয়ে যত ধরনের জলজপ্রাণী রয়েছে তার সবগুলো মারা পড়ে। এমন কি মাছগুলোও দীর্ষ সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারেনা। দেশের মাছের বাজারগুলোতে মাছে ফরমালিনের ব্যবহার বৃদ্ধির অন্যতম কারণও এটি। একজন অমৎস্যজীবী ইজারাদারের লক্ষ্য থাকে নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই জলমহল থেকে যতবেশি উপার্জন করা যায় তার দিকে। সেখানে কে বাঁচলো আর কে মরলো সেটি তার দেখবার বিষয় নয়। কেননা এই জলমহাল সে লিজ নিয়েছে ব্যবসা করার জন্য মাছ সংরক্ষণের জন্য নয়। কিন্তু একজন প্রকৃত মৎস্যজীবী কখোনই প্রাকৃতিক জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ করবে না। কেননা এটা তার সারা জীবনের জীবিকার সাথে সম্পৃক্ত।একজন মৎস্যজীবী তার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকেই জানে, জাল দিয়ে জলাশয়ের সকল মাছ তোলা সম্ভব নয়। সেটি সে চায়ও না। জিউল জাতিয় মাছ যেমন- কৈ, শিং, মাগুরসহ অনেক মাছ, বিশেষ করে মা মাছগুলো জলশয়ে জাল পড়ার সাথে সাথে জলাশয়ের খানাখন্দ বা গর্তের মধ্যে চলে যায়। যেখানে সে ছয় থেকে আট মাস পর্যন্ত বসবাস করতে পারে। পরবর্তী বছর বৃষ্টির পানি পেলেই তারা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পানিতে পোনা ছাড়ে। এই বিষয়গুলোকে জানা, অনুধাবন করা ও চর্চা করার ক্ষেত্রেই একজন মৎস্যজীবী ও অমৎস্যজীবী ইজারাদারদের জলমহাল ব্যবস্থাপনার মৌলিক পার্থক্য।

প্রাকৃতিক মাছের বৈচিত্র্য ও পরিমান কমে যাওয়ার ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর রাজস্ব আয়ের এক বড় অংশই ব্যয় করতে হচ্ছে। বিল নার্সারি, অভয় আশ্রম, মাছের পোনা অবমুক্তকরণের নামে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও প্রশাসন নির্ভর বাস্তবায়ন করতে সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সেই অর্থ যদি জলমহাল সংস্কার ও জেলেসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় করা হয়, তবে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক মাছ বৈচিত্র্যবাড়বে, সংরক্ষিত হবে প্রাকৃতিক জলমহাল অন্যদিকে দেশের হতদারিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে আসবে। মৎস্যজীবীদের নিজস্ব জ্ঞাননির্ভর পেশা থেকে উদ্বাস্ত হয়ে অদক্ষ গার্মেন্টস কর্মী বা রিক্সা শ্রমিক হিসেবে বস্তি জীবনের অভিজ্ঞতা নিতে হবেনা।

গোলটেবিল থেকে নি¤েœাক্ত সুপারিশসমূহ তুলে ধরা হলো:
- উন্মুক্ত পাবলিক জলাভূমি ও হাওর ইজারা দেয়া যাবে না।
- হাওর ও জলাভূমি বোর্ডের তত্ত¡াবধানে স্থানীয় প্রকৃত মৎস্যজীবীদের (যারা বংশ পরস্পরায় এই পেশার সাথে যুক্ত) সম্পৃক্ত করে যৌথভাবে হাওরের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলকে প্রাকৃতিক মাছ উৎপাদন, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ঘোষনা করে প্রাকৃতিক মাছ সংরক্ষণ করতে হবে।
- সংরক্ষিত এলাকা ছাড়া বর্ষা মৌসুমে ভাসান পানিতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাছ ধরার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
- মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মৎস্য বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি প্রকৃত মৎস্যজীবীদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক মাছ সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
- হাওর এলাকায় সরকারী উদ্যোগে পর্যাপ্ত পরিমানে পরিবেশ ও প্রতিবেশ উপযোগি হিজল ও করচ গাছের বনায়ন করতে হবে।
- সকল অমৎস্যজীবী সংগঠনকে মৎস্যজীবী হিসেবে যে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে তা বাতিল করতে হবে।
- জলমহলে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
- নতুন করে কোন অমৎস্যজীবী সংগঠনের রেজিষ্ট্রেশন দেওয়া যাবে না।
- কারেন্ট জালসহ হাওরের জলশয় পরিস্কারের নামে সকল ধরনের কীটনাশক ও বিষের ব্যবহার, উৎপাদন ও বিপন্ন সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ করতে হবে।
- এপ্রিল-জুন মাসে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে মা মাছ ধরা নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এই সময়ে জেলে পরিবারের জন্য বিনাসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
- হাওর এলাকায় রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেই সাথে হাওর এলাকায় শুধু ধান নয় অন্যান্য উপযোগী ফসল নির্বাচন ও চাষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে।
- হাওরের উৎপাদিত মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
- রাজস্ব হিসাব করে দেখতে হবে ইজারার টাকার পরিমান কত।
- ১৯৯৭ সালে পানি প্রবাহ কনভেনশনে জাতিসংঘ ঘোষণা করে সেখানে বাংলাদেশ সাক্ষর করে নাই। সাক্ষর করতে হবে।
হাওরের উজানে তথা মেঘালয় পাহাড়ে অপরিকল্পিত অবকাঠামো, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা ও পাথর উত্তোলন, প্রাকৃতিক বন ধবংস, পরিবেশ বিনাশী প্রকল্প গ্রহণ না করার জন্য ভারতের আন্ত:রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ ও আলোচনা বাড়াতে হবে।