বিষাক্ত খাদ্য লক্ষ লোকের মৃত্যুর কারণ খাদ্য দূষণকারীকে দূর্নীতিবাজ হিসাবে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি দেয়া হোক

বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারলে দেশ ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে। বাংলাদেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে ভেজাল ও বিষযুক্ত খাদ্য। এটি দেশকে ও মানুষকে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিবে। সরকার, নাগরিক সমাজ ও সর্বসাধারণের সচেতনতাই পারে এই পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে। আর খাদ্য দূষণকারীদের দূর্নীতিবাজ হিসাবে চিহ্নিত করে কঠোর আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষ্যে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন(পবা) ও বারসিক কর্তৃক আয়োজিত বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য ঃ বর্তমান অবস্থা ও করণীয় শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিলে আলোচনা করেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরী, গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ, ৭১ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা: খালেদ শওকত আলী, অ্যাড মাহবুবুল আলম তাহিন, বারসিকের সমন্বয়ক মো: জাহাঙ্গীর আলম, পবার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, কবি কামরুজ্জামান ভূইয়া, যুব ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো: শহীদুল্লাহ, শাকিল ওসমান. প্রাকৃতিক কৃষির দেলোয়ার জাহান, বস্তিবাসী নেত্রী ঝুমুর বেগম আলম প্রমূখ।
গোলটেবিলে বক্তারা বলেন, মানুষসহ সকল প্রাণসত্তার জন্য নিরাপদ খাদ্যের জোগানের ভেতর দিয়ে ভবিষ্যতের নির্মল পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় চাই সকল স্তরের এক সমন্বিত জাগরণ। আমাদের চারপাশের পরিবেশ আজ নানাভাবে দূষিত ও বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্যের জোগান দেয়া সত্যিই এক দুরূহ জটিল কাজ। কিন্তু আমাদের সকলের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য এবং ভবিষ্যতের নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই নিরাপদ ও বিষমুক্ত খাদ্যের জোগান জরুরি।

বক্তারা আরো বলেন, একজন ভোক্তা ও ক্রেতা হিসেবে প্রথমত আমরা খাদ্যটাকে নিরাপদ দেখতে চাই। নিরাপদ মানে ক্ষতিকর ও বিপদজনক রাসায়নিকমুক্ত খাদ্য। এ অবস্থায় খাদ্য উৎস ও উৎপাদনস্থলকেই প্রথমত নিরাপদ করাটা জরুরি। তারপর থাকছে খাদ্য সরবরাহ, পরিবহন, বিপণন, মজুতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিবেশন। জমির মাটি থেকে খাবার থালা অবধি খাদ্য নিরাপদ হওয়া জরুরি। খাবার নিরাপদ কীনা এ নিয়ে নিয়মিত খাদ্য পরীক্ষাটাও জরুরি। আমরা যেমন খাবারে কোনো ভেজাল চাই না, আবার ফরমালিন-কার্বাইড বা ক্ষতিকর কোনো উপাদান খাবারে মিশে থাকুক তাও চাইনা।

অতি মুনাফালোভী কৃষক, উৎপাদনকারী, মজুতকারী, পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি, ডিডিটি, কীটনাশক, কাপড়ের রং, রেল ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, মোটর যান, নৌ যান ও কলকারখানার পোড়া তেল ও মবিল মিশ্রিত তেল, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথেফেন, কৃত্রিম হরেমান ব্যবহার করছে। কৃষিজাত পণ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। মিষ্টিতে কাপড়ের রং প্রয়োগ করা হয়। শুটকি মাছ সংরক্ষণে ডিডিটি ও হেপ্টাক্লোর ব্যবহার করা হয়। এইসব রাসায়নিক মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কৃষিতে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এবং মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহার দেশের জনস্বাস্থ্যকে বিশাল ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। কৃষিপণ্যকে কীটনাশক থেকে রক্ষা করা গেলে মানুষ অনেকটা স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে।

জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে ৮২টি খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করা হয়। এতে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি নিষিদ্ধ ডিডিটি, এলড্রিন, ক্লোরডেন, হেপ্টাক্লোর এবং অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান পাওয়া যায়। এসব রাসায়নিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি রয়েছে। চালের ১৩টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়া সম্পন্ন আর্সেনিক, পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। হলুদের গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় ছিল সীসা ও অন্যান্য ধাতু। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি সীসা পাওয়া গেছে। মুরগির মাংস ও মাছে পাওয়া গেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব। হলুদ ও লবণে সীসাসহ আরো কিছু ধাতব উপাদান প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলো চকচকে ও ভারী করা হয়।

গোলটেবিল আলোচনা থেকে নিম্নোক্ত দাবিগুলো তুলে ধরা হয়:

করণীয়
১. খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি মিশানোর সাথে জড়িত এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদিযুক্ত ও ভেজাল খাদ্য বিক্রয়কারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ড প্রদান অব্যাহত রাখা।
২. ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এবং ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৫ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
৩. জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্যে বিষ বা ভেজালরোধে কোন রকম বৈষম্য বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারকে খাদ্যে বিষ ও ভেজাল মিশ্রণের উৎসমূল থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
৫. সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থের আমদানিকারক ও ব্যবহারকারী এবং লেবেল ছাড়া বা মিথ্যা লেবেলের অধীন কীটনাশক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৬. সময়োপযোগী কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা।
৭. গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার- প্রচারণার মাধ্যমে কৃষক, উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের রাসায়নিক দ্রব্যাদি, কীটনাশক, ভেজাল মিশ্রনের ক্ষতিকর দিক এবং আইনে বর্ণিত দন্ড তুলে ধরে সচেতন করা।
৮. পণ্য আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক বন্দরসমূহে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি পরীক্ষা করা।
৯. শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপনে শিল্প মালিকদের বাধ্য করা। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১০. খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা।
১১. বিষযুক্ত খাদ্যের ভয়াবহ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশে জৈব কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন ও একে জনপ্রিয় করে তোলা।