বায়ুদূষণ রোধে সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা চাই

বিশে^র দূষিত বায়ুর শহর গুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। ধুলার কারণে এই দূষণের মাত্রা এখন আরও ভয়াবহ। মাত্রাতিরিক্ত ইটভাটা, যানবাহন, নির্মাণকাজ ও কলকারখানার ধোঁয়ার কারণে ঢাকা শহরের প্রায় দেড় কোটি মানুষ আসলে এক অবিশ^াস্য বিষাক্ত গ্যাসের মাঝে বাস করছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা গত ১০ বছরে ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। জনসংখ্যা দিয়ে বায়ুদূষণ বিবেচনা করলে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত বায়ুর দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যে, ঢাকার বায়ু দূষণমাত্রা কত এবং বায়ু দূষণমাত্রা কমানোর জন্য কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা জরুরী ভিত্তিতে নির্ণয় করে সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

আজ ২৩ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, সকাল ১১.০০ টায় জাতীয় জাদুঘরের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম (নাসফ) ও পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চসহ সমমনা সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে ‘নগরে বিষ ঢালছে বায়ুদূষণ; বায়ুদূষণ বন্ধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ কর’-দাবীতে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যাক্ত করেন।

পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে এবং নাসফ-এর সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলীর সঞ্চালনায় উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান, নাসফের সম্পাদক মো. ওমর ফারুক, গোলাম হোসেন, সহ-সম্পাদক হাসিনা আরিফ, সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, সহ-সভাপতি মো. ফারুক হোসাইন, পবা’র সদস্য মো. সেলিম, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জায়েদ ইকবাল খান, সামাজিক আন্দোলন কর্মী রাজিয়া সামাদ, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিমউদ্দিন, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক শাকিল রহমান।

বক্তারা বলেন, আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ইটভাটা, যানবাহন, নির্মাণকাজ ও কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া। ঢাকার আশেপাশে ফসলের জমি দখল করে অবৈধভাবে শত শত ইটের ভাটা গড়ে উঠেছে। যার বেশির ভাগেই এখনো অবৈধ ড্রাম চিমনি ব্যবহার করছে। সালফারের মান যাচাই না করেই এসব ইটের ভাটায় নি¤œমানের কয়লা ব্যবহার করার পাশাপাশি কাঠ, টায়ার, প্লাস্টিক ইত্যাদি ক্ষতিকারক জ¦ালানী ব্যবহারের ফলে নির্গত হচ্ছে ধোঁয়া, ধূলিকণাসহ বিভিন্ন ধরণের ভারী ধাতবকণা। নির্গত হচ্ছে মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক সালফার ও নাইট্রোজেনযুক্ত অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, ব্ল্যাক-কার্বনসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান যা মানুষের চোখ, ফুসফুস ও শ^াসনালীর মারাত্মক ক্ষতিসাধনসহ স্বল্প সময়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।

বক্তারা আরো বলেন, যানজট সৃষ্টির পাশাপাশি রাজধানীর বায়ু দূষণেও অন্যতম ভূমিকা পালন করছে ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী অতিরিক্ত যানবাহন। ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করে। নগরীতে চলাচলকারী গণপরিবহনের প্রায় সবগুলো বাস-মিনিবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিক্সা, টেম্পোসহ অন্যান্য গাড়িসমূহ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে, ফিটনেসবিহীন এই সকল গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। এছাড়া গাড়িতে ব্যবহারকারী ভেজাল ও নি¤œমানের জ¦ালানীও দায়ী বায়ুদূষণে। অন্যদিকে মোটরযান চলাচলের প্রধান সড়কগুলো আবাসিক এলাকা সংলগ্ন হওয়ার কারনে এসব এলাকার লোকজন উচ্চহারে বায়ু দূষণের শিকার হচ্ছে।

অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় রাস্তা-ঘাট খোঁড়াখুঁড়ির পরিমান বৃদ্ধি পায়। মেট্রোরেলসহ অন্যান্য মেগাপ্রকল্পের জন্য রাস্তা ও আশেপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে খোঁড়াখুড়ি, গ্যাস-পানি, বিদ্যুতের লাইন স্থাপনের সময় রাস্তা খোঁড়াখুড়ি, মাটি, বালি, ইটসহ নির্মাণসামগ্রী আচ্ছাদনহীন ট্রাকে করে শহরে পরিবহন করা, ড্রেন পরিস্কার করে রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা, দোকান পাট ও গৃহস্থালীর আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, মেরামতহীন ভাংগাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, পাকা ভবন নির্মাণের সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা-ফুটপাতে ফেলে রাখা, পুরাতন ভবন ভাঙ্গা, মেশিনে ইট ভাঙ্গা, যানবাহনের কালো ধোঁয়ার পাশাপাশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ধুলা ও বায়ু দূষণের অন্যতম উৎস। এসব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ধুলা, বিষাক্ত ক্ষতিকারক গ্যাস ও ভারীধাতব কণা বাতাসে মিশে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

নগরবাসীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে অচিরেই বায়ু দূষণের উৎসসমূহ বন্ধ করতে হবে। বায়ু দূষণের সাথে জড়িত দায়ী ব্যাক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সর্বোপরি বায়ু দূষণের সকল উৎস বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নিয়মিতভাবে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত করতে হবে। ইট তৈরির অদক্ষ পদ্ধতি ব্যবহার না করে পরিবেশবান্ধব জ¦ালানিসাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জনদুর্ভোগ লাঘবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা এবং তা নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। উল্লেখ্য, পরিসেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহ কর্তৃক অবকাঠামো তৈরি, সম্প্রসারণ ও মেরামত করার সময় খননকৃত মাটি ও অন্যান্য সামগ্রী রাস্তায় ফেলে না রেখে দ্রুত অপসারণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন করা হলেও এই অর্থের সঠিক ব্যবহার দৃষ্টিগোচর হয় না। দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

সুপারিশ
* বায়ুদূষণ রোধে সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা করা।
* ইট প্রস্তুতে আধুনিক প্রযুক্তি ও লো সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহার করা।
* যানবাহন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নত মানের জ্বালানী আমদানি ও ব্যবহার করা।
* ধুলা দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনসমূহ বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে তাদের উপর অর্পিত আইনানুগ দায়িত্ব আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতার সাথে পালন করা।
* কলকারখানায় বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
* পরিসেবার অবকাঠামো তৈরি, সম্প্রসারণ ও মেরামত করার সময় খননকৃত মাটি ও অন্যান্য সামগ্রী রাস্তায় ফেলে না রেখে দ্রুত সরিয়ে নেয়া এবং দ্রুত রাস্তা মেরামত করা । একাজে ব্যর্থ হলে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া।
* রাস্তাঘাট ও ফুটপাত নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করা।
* ভবন নির্মাণ ও মেরামত বা অন্য যে কোন অবকাঠামো নির্মাণের সময় নির্মাণ সামগ্রী ফুটপাত বা রাস্তার উপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় না রাখা।
*ধূলা সৃষ্টি করে এমন কোন সামগ্রী (বালু, মাটি, ইট, পাথর) বহনের সময় সঠিকভাবে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা নেয়া।
* নালা-নর্দমা পরিস্কার করার পর আবর্জনা রাস্তার পাশে জমিয়ে না রাখা এবং দ্রুততম সময়ে সরিয়ে নেয়া।
* বায়ুদূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার ও বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম এবং সচেতন মহলের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা।