চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য গবেষণাই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য বিষয় "

বিদ্যমান বৈশি^ক ব্যবস্থায় দ্রুত বিকাশমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিপর্যয়রোধসহ স্থায়িত্বশীল অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সক্ষমতা নির্ভর করে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং সফলতার সাথে দ্রুত এর বাস্তবায়ন সক্ষমতার উপর। আমাদেরও সামগ্রিক অগ্রযাত্রা এমনকি টিকে থাকাও বহুলাংশে নির্ভর করবে বিশ^বিদ্যালয়ের মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা এবং গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। আমাদের দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলো যুগের এই চাহিদা পূরণে সক্ষমতা বৃদ্ধি খুবই ধীরলয়ে চলছে বা সফলতা খুবই সীমিত।

বিদ্যমান বিশ্ব অর্থনীতিক ব্যবস্থায় গার্মেন্টস্ এবং ট্যানারী শিল্পের মতো দূষণকারী শিল্পগুলো আমাদের দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। দূষণকারী শিল্পগুলোই বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। এই সমস্ত শিল্পের উপর নির্ভর করে দীর্ঘমেয়াদে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন বা উন্নত দেশ হওয়া সম্ভব নয়। পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করে উন্নত দেশ বা মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করতে হলে সামিল হতে হবে জ্ঞাণবিজ্ঞানভিত্তিক চতুর্থ শিল্পবিপ্লব রথযাত্রায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল পেতে হলে প্রয়োজন মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালেয় শিক্ষা ব্যবস্থা। এ প্রেক্ষিতে আলোচনায় সকলেই গুরুত্ব দেন গবেষণাই হোক বিশ^বিদ্যালয়ের মুখ্য বিষয়।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), জনউদ্যোগ এবং আইইডি যৌথ উদ্যোগে ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০, শনিবার সকাল ১১.০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে “গবেষণাই হোক বিশ^বিদ্যালয়ের মূখ্য বিষয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সংসদের সম্মানিত রিসার্চ ডিরেক্টর কাজী সামিও শীশ। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন স্ট্যামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আলী নকী, জনউদ্যোগ জাতীয় কমিটির আহবায়ক ডা. মুশতাক হোসেন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিভাগ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন, বাসদের কেন্দ্রীয় সাবেক ছাত্রনেতা রাজেকুজ্জামান রতন, জনউদ্যোগ জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব তারিক হোসেন মিঠুল, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল্লাহ সাদেক ও তাহমিদুল ইসলাম, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মেহেদী হাসান নোবেল, বিসিএইচআরডি এর সভাপতি মাহাবুব হক প্রমুখ।

মূল প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সংসদের সম্মানিত রিসার্চ ডিরেক্টর কাজী সামিও শীশ বলেন, গবেষণার জন্য প্রয়োজন ১. গবেষকের মতো চিন্তা করার দক্ষতা ২. গবেষকের মতো পাঠ করার দক্ষতা ৩.গবেষকের মতো লিখতে পারার দক্ষতা। এই ত্রয়ী দক্ষতা ব্যক্তির নিজস্ব চেষ্টা ও সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা অর্জনযোগ্য। আর সম্মিলিতভাবে এই দক্ষতা (চিন্তা-পাঠ-প্রকাশ) অর্জন ও বৃদ্ধির জন্যে সবচাইতে উপযোগী স্থান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়।

গবেষক হওয়ার দক্ষতাগুলো অর্জন করার জন্যে কোর্সের সিলোবাস সম্পন্ন আর গবেষণা পদ্ধতি ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু যথেষ্ট নয়। চিন্তা, পাঠ ও চিন্তার প্রকাশের ( মৌখিক ও লিখিত) জন্যে চাই উপযোগী পরিবেশ। এই জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে দরকার নিয়মিত বিতর্ক ও সংস্কৃতি চর্চার জন্যে উপযোগী পরিবেশ। এই পরিবেশ সৃষ্টি এবং ভিন্ন মতপ্রকাশকারীদের জন্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নিজস্ব একাডেমিক বিষয়ের বাইরেও বহুমুখি (বিশেষ করে সাহিত্য ও দর্শন সংক্রান্ত) পাঠ। এর জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গবেষক সকলের উদ্যোগে নানা ধরনের পাঠচক্র আয়োজনের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সহয়তা (মুক্তমঞ্চ, গ্রæপ স্টাডি রুম ইত্যাদি) প্রদান করা প্রয়োজন। জ্ঞান অর্জন ও গবেষণা করা একটি ধীর প্রক্রিয়া এবং এর জন্যে পাঠ, ভাবনা ও পুনর্পাঠ ও পুনর্ভাবনা প্রয়োজন। সকল বিষয়ের জন্যে সেমিস্টার পদ্ধতি উপযোগী কি না, গবেষকদের একক ও সম্মিলিত গবেষণা উদ্যোগ নিতে এই পদ্ধতি অন্তরায় হচ্ছে কি না এই বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেবে দেখা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই বিষয়ে গবেষণা করতে পারে। গবেষণার জন্যে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারণ এবং বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই দায়িত্বের যথাযথ পালন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, সকল শিক্ষার্থীর মাঝে সম্ভাবনা থাকে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃত শিক্ষার্থী ও গবেষক তৈরি করা। তিনি আরো বলেন, প্রকৃত মানবিকগুণ সম্পন্ন সৎ মানুষ ও গবেষক তৈরির জন্য সামগ্রিক ইকো সিস্টেমের উপর গুরুত্বারোপ করেন।

বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান কাজ জ্ঞানের সৃষ্টি বা নতুন নতুন কৌশল আবিস্কার করা। অর্থাৎ গবেষণা করাই বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান কাজ। অধ্যাপকের প্রধান দায়িত্ব গবেষণা কাজের সুপারভাইজ করা বা কোন কোন সময় গবেষণা কাজের নেতৃত্ব দেওয়া। বাস্তবতা আমরা সকলেই কমবেশি জানি। বাংলাদেশে প্রফেসরের সংখ্যা পশ্চিম ইউরোপের সকল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসরের সংখ্যা থেকেও অধিক মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টেশন যদি গবেষণা করার দিকে থাকে ছাত্র শিক্ষক সকলেই এই গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করে তখন পড়াশোনায় সার্বক্ষণিক ধ্যানে পরিনত হয়ে যায় তখন অন্য কাজে মনোনিবেশ করার সুযোগ থাকে প্রধান কাজ গবেষণা যদি না হয় তবে ছাত্র বা শিক্ষকেরা পড়াশোনা ভিন্ন অন্য কাজের সুযোগ মনোনিবেশ বেড়ে যায়। গবেষণা ছাড়া পড়াশোনায় দীর্ঘক্ষণ মনোসংযোগ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পরে। অনেকেই উল্লেখ করেন, গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত তহবীল সদ্বব্যবহার হয় না বা গুণগতমান সম্পন্ন গবেষণা খুব কমই হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন জ্ঞানতাপস। ছাত্রদের তিনি উদ্বুদ্ধ ও গাইড করবেন জ্ঞান অণে¦ষনে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যখন জ্ঞানতাপস হবেন তখন তারা অন্যকিছুতে সংযুক্তির সুযোগ কম পাবেন। আর কোথাও যুক্ত হলেও তা হবে মানসম্মত। তবে গবেষণায় মনোনিবেশ না থাকায় প্রচলিত শুধু পরীক্ষাকেন্দ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থায় খুব কম শিক্ষার্থীর পক্ষে জ্ঞানতাপস হওয়া সম্ভব।

অদূর ভবিষ্যৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের ফলে বিশেষ করে এ আই এর ব্যবহারের ফলে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা ড্রাইভারের মতোই অনেক পেশা দ্রুত- অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। জ্ঞানতাপসরাই দ্রুত পরিবর্তনশীল তথ্য প্রযুক্তির যুগে টিকে থাকতে পারবে। অন্য অনেক পেশাজীবী সমাজে অর্থনৈতিকভাবে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। আর তখন তারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অপাঙতেয় হয়ে যাবে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে না পারলে অনেক জাতি গোষ্ঠী ও রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে অপ্রয়োজনীয় হবার কারণে অপাঙতেয় হয়ে যাবে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থাই ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে বাঁচাতে পারে এবং কি উন্নয়নের সোপানে পৌছে দিতে পারে। গবেষণার জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ, প্রয়োজনীয় তহবীল।