পর্বতারোহী, সাইক্লিস্ট ও দৌড়বিদ রেশমা নাহার রত্না হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও নিরাপদ যাতায়াতের নিশ্চয়তা চাই।

গত ৭ আগস্ট ২০২০, শুক্রবার সকাল ৯টায় রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকার চন্দ্রিমা উদ্যান সংলগ্ন লেকরোডে সাইক্লিং করার সময় শিক্ষক, পর্বাতারোহী, সাইক্লিস্ট ও দৌড়বিদ রেশমা নাহার রত্নাকে একটি মাইক্রোবাস চাপা দিয়ে হত্যা করে দ্রুত পালিয়ে যায়। রেশমা পৃথিবীর দুর্গম পর্বত জয় করে ফিরে আসলেও ঢাকা শহরের বিপদজ্জনক রাস্তা তার জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে। গতকালও কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত হয়েছেন। এই রেশমার মতো প্রতিবছর সড়ক দূর্ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়ে কেঊ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। এছাড়া নৌপথ এবং রেলপথেও হাজার হাজার মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছে। ফলে যাতায়াতে নিরাপত্তা নিয়ে সকলেই শংকিত। সড়কে প্রতিদিনই বাড়ছে দুর্ঘটনা বা হত্যাকান্ড। দুর্ঘটনার নামে এধরণের হত্যাকান্ড আর কত? অবিলম্বে রেশমা নাহার রত্না হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবীতে আজ ০৯ আগস্ট ২০২০, রবিবার, সকাল ১১.০০ টায় শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘরের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), গ্রীনফোর্স, ডাব্লিঊবিবি ট্্রাস্ট, বানিপা, বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশন, ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদ, সুরক্ষা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ গারো আদিবাসী লীগ, বাংলাদেশ মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশন, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশন, নোঙরসহ সমমনা সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে এক অবস্থান কর্মসূচীতে বক্তারা উক্ত দাবী জানান।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও পবার সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালনায় অবস্থান কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হর্কাস ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাশেম, ঢাবির শিক্ষক ও গবেষক কাজী সামিও শীষ, পবার সম্পাদক মেসবাহ্ উদ্দিন সুমন, পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার, বানিপার সভাপতি প্রকৌ: মো: আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদ এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুববুস, নোঙর এর সভাপতি শামস্ সুমন, বাংলাদেশ মাউন্টেনিং ফেডারেশন এর সাধারণ সম্পাদক অপার আহমেদ, গবেষক খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার, বাংলাদেশ নদী বাচাঁও আন্দোলন এর সদস্য সচিব শাকিল রহমান, নাসফ‘র সহ সম্পাদক মো: সেলিম, জাতীয় ক্রীড়াবিদ সুলতানা মৌসুমী, সচেতন নগরবাসীর সভাপতি জি এম রোস্তম খান, সাইক্লিস্ট কাজী খোকন প্রমুখ।

২০১৭ সালে মোট সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৪,৯৭৯টি, যাতে মৃত্যু হয়েছিল ৭,৩৯৭ জনের। ২০১৮ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছিল ৫,৫১৪টি। যেখানে প্রাণ হারিয়েছিল ৭,২২১ জন। সড়ক দুর্ঘটনা ছাড়াও গত এক বছরে রেল পথে ৪৮২টি দুর্ঘটনায় ৪৬৯ জন নিহত এবং নৌপথে ২০৩টি দুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত হয়েছেন। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে গত জুন মাসে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩৫৮টি দুর্ঘটনায় ৩৬৮ জন নিহত ও ৫১৮ জন আহত হয়েছে। একই সময়ে রেলপথে ২০টি দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছে। নৌ পথে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১৭টি। এতে নিহত হয়েছে ৪৫ জন, আহত হয়েছে ৬০ জন এবং নিখোঁজ রয়েছেন ১০ জন।

প্রতি বৎসর সড়ক দূর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষ আহত হয় ও মৃত্যুবরণ করে। এর ফলে দূর্ঘটনায় পতিত পরিবারগুলো দারিদ্রসীমার নিচে চলে যায়। যারা তৎক্ষনাত মৃত্যুবরণ করে, প্রকৃতপক্ষে তারা মরে গিয়ে বেঁেচ যায়। আর যারা গুরুতর আহত হয় বা পঙ্গুত্ব বরণ করে, তারা দীর্ঘদিন যাবৎ ক্ষত বয়ে বেড়ায় অথবা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করে। ফলে, আহত রোগীর পরিবার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে এবং কর্মহীন হয়ে যাওয়ার কারনে নিঃস্ব হয়ে যায় কিংবা ভয়াল অর্থনৈতিক দুর্দশার কবলে পড়ে। বছরে এই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়।

প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে যান্ত্রিক বাহনে করে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। নীতিমালায় ও আইন পথচারীদের অগ্রাধিকার বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এমনকি পথচারি পারাপারে সুব্যবস্থা অধিকাংশ রাস্তায় নেই। পরিবেশ বাচাঁও আন্দোলন (পবা) ও সমমনা সংগঠনগুলো জনগণকে সাইকেল চালাতে উৎসাহিত করার সাথে সাথে সাইকেলের জন্য আলাদা সড়ক বা লেন এর আন্দোলন করে আসছে। সাইকেলের ব্যবহার ইদানিং বৃদ্ধি পেলেও সাইকেলের জন্য আলাদা লেন বা প্রয়োজনিয় সুযোগ সুবিধা এখনো নাই। কার্যত প্রাইভেট কার কেন্দ্রীক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। এর ফলে রাস্তার তুলনায় প্রাইভেট কার ও অন্যান্য গাড়ি অনেক বেশি। কিন্তু প্রয়োজন ছিল ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা বিশেষ করে ভালো সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন পরিকল্পনা মাফিক যাত্রীবান্ধব বড় বড় বাস। পর্যাপ্ত বাসের অভাবে এবং সড়ক পরিবহনে মাফিয়া চক্রের কারনে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না। ফলে বিশেষ করে “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮” বাস্তবায়নে শিথিলতার কারনে বেপরোয়া গাড়ি চালানো কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। ফলে দুর্ঘটনার নামে হত্যাকান্ড বেড়েই চলছে। এরই মাঝে গভীর রাতে এবং ভোরে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চলাচল বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনই একটি বেপরোয়া গাড়ি চালানোর শিকার রেশমা নাহার রত্না।

করোনাকালীন সময়ে সব ধরনের বাস, মিনিবাস আসন সংখ্যার অর্ধেকের বেশি যত্রিী বহন করা যাবে না এমন নির্দশনা দিয়ে আন্ত:জেলা ও দুরপাল্লা দুই রুটে ভাড়া বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সরকারের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সামাজিক দুরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানতেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। এজন্য বাস মালিকরা ৬০ ভাগ ভাড়া বাড়িয়েছে। কিন্তু সরকার থেকে যে স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হয়েছিল তা বাস কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই মেনে চলছে না। বর্তমানে অধিকাংশ দেখা যাচ্ছে বাসে অতিরিক্ত গাদাগাদি করে বাস ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত চলাচল করছে না এবং তুলনামূলকভাবে ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়াভাবে বাসগুলো চলচল করছে। যাত্রীরাও নিরুপায় হয়ে দ্বিগুনেরও বেশি ভাড়া দিয়েও স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গাদাগাদি করে রাস্তার মাঝখান থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসে উঠতে বাধ্য হচ্ছে।

সুপারিশসমুহ:

# রেশমা নাহার রত্না হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই
# কোন শিথিলতা নয়, চাই “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮” এর পূর্নাঙ্গ ও দ্রুত বাস্তবায়ন।
# সাইকেলের জন্য আলাদা লেন চাই।
# আইন ও নীতিমালার উল্লেখ অনুযায়ী পথচারীদের অগ্রাধিকার বিষয়টি ব্যাপক ভিত্তিতে বাস্তবায়ন চাই।
# গভীর রাতে এবং ভোরে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে।
# সড়কে যাতায়াতে শৃংখলার স্বার্থে পর্যাপ্ত পরিমানে বড় বড় বাস নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত বাসের যোগানের প্রয়োজনে বিআরটিসি কর্তৃক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লিজ প্রদানকৃত বাসগুলি রাস্তায় চলাচলের ব্যবস্থা করা। পর্যাপ্ত বাস রাস্তায় চলাচল করলে সড়কে শৃংখলার পাশাপাশি বর্তমান আদায়কৃত বর্ধিত বাস ভাড়া থেকে যাত্রীসাধারণ নিস্কৃতি পাবে।