নগরে জলাবদ্ধতা ও জনদুর্ভোগ নিরসনে করণীয়

একটি আদর্শ শহরে কমপক্ষে শতকরা ২৫ ভাগ উন্মুক্ত এলাকা এবং ১৫ ভাগ জলাধার থাকা প্রয়োজন। কিন্তু রাজধানীর মতো জনবহুল শহরে উন্মুক্ত এলাকা নেই বললেই চলে। যা ছিল তা দিন দিন ইট পাথরের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ১৯৮৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জলাশয়ের প্রায় অর্ধেক হারিয়ে গেছে। ২৮ বছরে জলাশয় হারিয়ে যাওয়া হার শতকরা ৭২ ভাগ। একই চিত্র নিম্নাঞ্চলের ক্ষেত্রেও। ফলে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর প্রায় সব কয়টি বর্ষা মৌসুমে একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধ হয়ে নাগরিক জীবনে চরম দুর্ভোগ বয়ে আনছে।

আজ ২৫ জুলাই ২০২০, শনিবার সকাল ১১.০০টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার উদ্যোগে অনলাইনে " নগরে জলাবদ্ধতা ও জনদুর্ভোগ নিরসনে করণীয়" শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আকতার মাহমুদ, নগর পরিকল্পনাবিদ, সভাপতি বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)। জনাব আবু নাসের খান, চেয়ারম্যান, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, পবা। জনাব মোঃ এনামুল হক আবুল, কাউন্সিলর, ১৩ নং ওয়ার্ড, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। জনাব আসিফ আহমেদ, কাউন্সিলর, ৩৩ নং ওয়ার্ড, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। হাফিজুর রহমান ময়না, সভাপতি নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম (নাসফ) এবং এম এ ওয়াহেদ, সম্পাদক পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)
আলোচনা অনুষ্ঠানে বর্তমান পরিস্থিতি পত্র উপস্থাপন করেন প্রকৌশলী আবদুস সোবহান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সাধারণ সম্পাদক, পবা। অনলাইন আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন পবার সম্পাদক ও গ্রিন ফোর্স সমন্বয়ক মেসবাহ সুমন।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, পানি নিষ্কাশনের কোনো জায়গা না থাকার কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হলেও এর অগ্রগতি হতাশাজনক। জলাবদ্ধতা নিরসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কমিটমেন্টের অভাব, আইন প্রতিপালন ও বাস্তবায়নের অভাব, জবাবদিহিতার অভাব, উদাসীনতা এবং প্রভাবশালীদের দখল ও ভরাট এবং জনগণের সচেতনতার অভাবে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের অধিকাংশ খাল হারিয়ে গেছে। টিকে থাকাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নেই। নদীর সাথে সংযোগও প্রায় কাটা পড়ছে। আর জলাবদ্ধ হয়ে এর পরিণতি ভোগ করছে নগরবাসী। ঢাকা নগরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ কোনো সহজসাধ্য ও স্বল্প দিনের কাজ নয়। এর জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা, সঠিক সমন্বয় ও পরিকল্পিত কার্যক্রম।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ জানান আমাদের দেশে পরিকল্পনার সংখ্যা কম নয়। অনেক পরিকল্পনা তৈরী হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হয়নি। তিনি বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ৭টি প্রস্তাব তুলে ধরেন-

১. পানির প্রবাহ নির্বিঘ্নে রাখার জন্য ৫২টি খালসহ ঢাকার ড্রেনের সংযোগ নদীর সাথে উন্মুক্ত রাখা।
২. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা। সিটি করপোরেশন ৬০% ময়লা পরিস্কার করে। এখন থেকে প্লান করে ১০০% ময়লা পরিস্কারের ব্যবস্থা করা।
৩. রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ব্যবস্থা করা। এতে জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে আসবে।
৪. উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খালের ব্যবহার করতে হবে।
৫. ঢাকার মাস্টারপ্লান ও ডিটেইল এরিয়া প্লান অনুসারে যে পাঁচটি ওয়াটার রিটেইনশন পন্ড আছে সেগুলোকে দ্রুত উদ্ধার করে কার্যকর করা।
৬. পার্ক, মাঠ, জলাধার আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা।
৭. মাস্টারপ্লান অনুসারে যে নগর সরকার করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে মেয়রের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়ে সমন্বয় কমিটি গঠন করা।

ঢাকা দক্ষিনের ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোঃ এনামুল হক আবুল বলেন, বেশ কয়েকবছর ধরে শান্তিনগর এলাকায় বৃষ্টি হলেই পানি জমতো কিন্তু বর্তমানে এই এলাকায় অনেক উন্নতি হয়েছে। কারণ এলাকার সরু রাস্তাগুলোকে বড় করা হয়েছে, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয়েছে। এবারের নির্বাচনে মেয়র ফজলে নূর তাপস এই এলাকা উন্নয়নে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং সেই মোতাবেক কাজ শুরু করেছেন। যেমন রাস্তায় যেসকল বড় বড় ডাস্টবিন ছিল সেগুলো তিনি সরিয়ে ফেলেছেন যেন রাস্তায় গাড়ি চলাচলে কেন সমস্যা না হয়। তিনি আরও বলেন এবছরে যতটুকু জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল আগামী বর্ষায় তা একেবারেই থাকবে না।

ঢাকা উত্তরের ৩৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ বলেন, সরকার সিটি করপোরেশনে কোন কোন কাজের জন্য কোন এলাকায় কি পরিমাণ ফান্ড দিচ্ছে তা সবাইকে জানাতে হবে। ওয়াসা শুধু পানি সাপ্লাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে কিন্তু তাদের খালগুলো যে পরিমান পরিস্কার করা দরকার তা করে না। সিটি করপোরেশনের সাথে অনান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের অভাব এজন্য কাউন্সিলরদের কাজ করতে গেলে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এলাকার খালের পাশ দিয়ে অবৈধ গ্যাস ও পানির লাইন থাকায় খালের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিস্কার কর্মী সংখ্যা অনেক কম। এলাকার বাড়ি ও বাজার থেকে ময়লা ফেলা হয় খালগুলোতে এটা বন্ধ করার জন্য জরিমানার ব্যবস্থা না করা হলে সারা বছর সিটি করপোরেশন পরিস্কার করলেও কোন লাভ হবে না। এরজন্য দ্রুত আইনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এলাকায় তদারকি টিম গঠন করা হয়েছে। খালের জমি অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয়রা দখল করে স্থাপনা তৈরি করেছে। এজন্য বহুবার সিটি করপোরেশন থেকে রাজউকসহ অনান্য প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে কিন্তু সেখান থেকে কোন ফিডব্যাক পাওয়া যায় না। এছাড়া খালের জমিগুলো বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানিগুলো দখল করে নিয়েছে। নাগরিকদের সচেতন করতে হবে না হলে একার পক্ষে সিটি করপোরেশনের কাজ করা সম্ভব নয়।

হাফিজুর রহমান ময়না বলেন, নাগরিকদের কারণে যে জনদূর্ভোগ হচ্ছে সেজন্য শুধু সচেতন করলেই হব না আইনের আওতায় আনতে হবে।

পবার নেতৃবৃন্দ বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে নগরবাসীর জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে আসে এবং পরিবেশ ও ভৌত অবকাঠামোর যে ক্ষতি সাধিত হয় তার দায় ভার অবশ্যই দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর উপর বর্তায়। এই অবস্থা নিরসনে আমাদের সুপারিশ হলোঃ-

# বিদ্যমান খালগুলি দখলমুক্ত ও খনন করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

# খাল, ড্রেন পরিস্কার রাখতে হবে। কোথায়ও যেন পলিথিন, প্লাস্টিক বা আবর্জনা আটকে না থাকে।

# নাগরিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং তা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে।

# বক্স কালভার্টগুলো উন্মুক্ত করে পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে।

# ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানে প্রস্তাবিত ৫টি পানির জলাধার তৈরির জন্য চিহ্নিত ৩৫৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে জলাধার তৈরি করতে হবে।

# বিল্ডিং কোড অনুযায়ী বাড়িঘর, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে সরকারি স্থাপনার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

# জনগণকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

Discussion Live Link: https://www.facebook.com/watch/?v=315320846258784