তামাক জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করছে
যত্রতত্র তামাক জাতীয় পণ্য বিক্রি এবং চাষ বন্ধ করে তামাককে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবসের অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তারা। বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে ”করোনা অতিমারিতে নগরের নিম্ন আয়ের মানুষসহ সকলে মিলে তামাকমুক্ত নগর গড়ি” শীর্ষক অনলাইন আলোচনা সভাটি আজ সকাল ১১ টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন ও বারসিক এর যৌথ উদ্যোগে পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আব্দুস সোবহান-এর সভাপতিত্বে ও বারসিকের অঞ্চল সমন্বয়কারী মো: শহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রোমান হক, মাদবদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এর উপপরিচালক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, তামাকবিরোধী জোটের সমন্বয়ক সাইফুদ্দিন আহমেদ , বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ, দ্যা ইউনিয়নের টেকনিক্যাল এডভাইজার সৈয়দ মাহবুবুল আলম, বারসিকের প্রজেক্ট ম্যানেজার ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল,প্রত্যাশা মাদকবিরোধী সংগঠনের সেক্রেটারী জেনারেল হেলাল আহমেদ, সাংবাদিক ইয়ারব হোসেন, মানিকগঞ্জ থেকে শাহাদৎ হোসেন বাদল, বসিÍবাসী অধিকার সুরক্ষা কমিটির সভাপ্রধান হোসনে আরা বেগম রাফেজা, সুদিপ্তা কর্মকার প্রমূখ। অনুষ্ঠানের শুরুতে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন বারসিকের সমন্বয়ক মো: জাহাঙ্গীর আলম।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, মাদক কতটা ক্ষতিকর বর্তমান এই অতিমারীতে আমরা আবার নতুন করে দেখতে পাচ্ছি। যারা মাদক গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে করোনায় মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা অনেক বেশি বলে বর্তমান অনেক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে। তাই মাদক মুক্ত সমাজ গঠনের কোন বিকল্প নেই আমাদের সামনে। প্রতি বছর দিবস আসে-দিবস যায়, তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার বন্ধে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন হয়ে থাকে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় প্রতিবছর তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার বেড়েইে চলেছে। এর কারন হিসেবে অনেকে মনে করেন জনসচেতনতা এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাব। বক্তারা আরও বলেন, তামাক জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করছে ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রোমানা হক বলেন, সুনির্দিষ্ঠ কর কাঠামোর মাধ্যমে তামাকের কর বাড়াতে হবে এবং তামাক জাতীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। এবং যুব সমাজকে তামাক থেকে মুক্ত করার জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
প্রকৌশলী মোঃ আব্দুস সোবহান বলেন, যতদিন তামাক পুরোপুরি নিষিদ্ধ না হচ্ছে, ততদিন যত্রতত্র তামাক জাতীয় পণ্য বিক্রি বন্ধ করে সুনির্দিষ্ট স্থানে বিক্রি করতে হবে। অধিক কর আরোপ ও আইনের যথার্থ ব্যবহার করতে হবে। তামাকবিরোধী জোটের সমন্বয়ক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের তামাকবিরোধী আইন সংশোধন করে আরও যুগোপযোগী করতে হবে।গবেষক ও বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ বলেন, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ী এলাকায় কর্পোরেট কোম্পানীগুলো তামাকচাষের ব্যবস্থা করে এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করছে। একই ভাবে রংপুর, দিনাজপুর, মানিকগঞ্জ এলাকায় তামাক চাষে ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের উদ্ধুদ্ধ করছে এবং তামাক প্রক্রিয়াজাত করনে প্রচুর কাঠ ও জ¦ালানী ব্যবহারের কারণে বনজ সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে।
আজ ৩১ মে, প্রতি বছরের মতো আজকেও সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে “বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস ২০২১” এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় 'Commit to quit' যার বাংলা ভাবার্থ করা হয়েছে-”আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, জীবন বাঁচাতে তামাক ছাড়ি”। তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিপুল জনসংখ্যা, দারিদ্রতা, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবের কারণে বিশ্বের সর্বোচ্চ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ অনুসারে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের উর্ধ্বে ৩৫.৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাকজাত দ্রব্য (ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন) ব্যবহার করে যার মধ্যে ৪৬ শতাংশ পুরুষ এবং ২৫.২ শতাংশ মহিলা। বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান না করেও পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হচ্ছে বহু মানুষ। এই হার কর্মক্ষেত্রে ৪২.৭ শতাংশ, রেস্তোরায় ৪৯.৭ শতাংশ, সরকারি কার্যালয়ে ২১.৬ শতাংশ, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ১২.৭ শতাংশ এবং পাবলিক পরিবহনে ৪৪ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা যায় নগরের মানুষ বেশী পরিমান তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে থাকে। সার্বিক ক্ষেত্রে নগরেই সব থেকে বেশি তামাকজাত দ্রব্য বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। নগরের মধ্যে আবার যারা নিম্ন আয়ের বস্তিবাসী মানুষ, তাদের মধ্যে নিম্নমানের তামাকজাত দ্রব্যসহ অন্যান্য মাদক গ্রহণের পরিমান তুলনামূলকভাবে বেশী লক্ষ্য করা যায়, যা তাদের জীবন এবং পরিবারের জন্য মারাত্মক প্রভাব তৈরী করে। এই নিম্নআয়ের মানুষেরা সচেতনতার অভাবে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েসহ এই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। দেশের জনশক্তির এই বিরাট অংশ জাতীয় উন্নয়নে আরো ভুমিকা রাখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জনবহুল শহরে একজন তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার করলে তার পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়ে বেশি আরেক জনের উপর। অন্যদিকে দেখা গেছে, বিশ্বে করোনা মহামারীতে সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন ধুমপায়ীরা। ইতালিতে স্বাস্থ্য গবেষণা এজেন্সি তাঁদের গবেষণায় বলেছেন-করোনায় মৃতদের মধ্যে ৭০ শতাংশই পুরুষ, তারা বেশিরভাগই ধুমপানে আসক্ত ছিলো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে- যারা ধুমপান করেন তাদের কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝঁকি বেশি হবার সম্ভাবনা আছে। সার্বিকরক্ষেত্রে দেখা যায় করোনা মাহামারীতে ধুমপায়ীরাই বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন এবং তাদেরই মৃত্যুর ঝঁকি বেশি।
প্রতিবছর বাংলাদেশে তামাকজনিত মৃত্যু এবং অসুস্থতার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমান ৩০ হাজার ৫৬০ টাকা যা জিডিপির ১.৪ ভাগ আর এই খাত থেকে সরকারী রাজস্ব পাচ্ছে ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। তামাক বিরোধী সংগঠন বলছেন, সরকারের দুর্বল কর কাঠামো এবং আইন প্রয়োগের অভাবে দিন দিন বাড়ছে তামাক সেবন।
তামাকজাত নিয়ন্ত্রণ ও তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ২০০৩ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ৫৬ তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ফ্রমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) চুক্তি অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ এই চুক্তির প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ এবং ২০০৪ সালে এ চুক্তিকে অনুসমর্থন করে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার এফসিটিসি’র আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এবং ২০১৫ সালে এ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করে। অন্যদিকে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ এবং যথাযথ প্রয়োগ চোখে পড়ার মতো নয়। আবার দেখা যায়, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় ও বিপণন নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এমনকি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্তদের নির্ধারিত কোন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণের ব্যবস্থা নেই। এ কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রের আশেপাশের এলাকা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্ট সহ বিভিন্ন স্থানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে তামাকজাত পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে। সহজলভ্যতা ও সহজপ্রাপ্যতার কারণে বাড়ছে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা। দিনে দিনে তা আরো ভয়াবহ আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরের মধ্যে এই প্রভাব দিনে দিনে মারাত্বক সংকট তৈরী করছে।
নগরের নিম্ন আয়ের মানুষদের ব্যবহার করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ধুমপান ও মাদকের আখড়া গড়ে তোলে। নগরের বস্তিসহ অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষগুলো নিরুপায় হয়ে দুষ্কৃতিকারীদের মাধ্যমে ব্যবহার হয়ে থাকে। তরুণরাই সব থেকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
তাই আমরা মনে করি:
১. তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন নয়, চাই এর বাস্তবসম্মত প্রয়োগ ।
২. তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় ও বিপণন নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে ।
৩. তামাকদ্রব্য বিক্রির ক্ষেত্রে আলাদাভাবে লাইসেন্স প্রদান করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. তামাকজাত দ্রব্যকে নিরুৎসাহিত করতে নগরে এবং গ্রামের পাশাপাশি স্কুল, কলেজসহ সকল ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কার্যকর জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
৫. ১৮ বছরের কম বয়সীদেরকে তামাকদ্রব্য গ্রহণের জন্য শান্তিমূলক ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাবলিক প্লেসে ধুমপানসহ মাদকদ্রব্যগ্রহণ রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
৬. সরকারী উদ্যোগে সকল মিডিয়াতে তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে নিয়মিত প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।