করোনা সংকট, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও আমাদের প্রস্তাব

করোনার প্রচন্ড আঘাতে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দৈন্যদশা প্রকটিত হয়েছে। এই বৈশ্বিক মহামারী করোনা মোকাবিলার দুটো ক্ষেত্র রয়েছে। একটি হলো সংক্রমণ ঘটার আগেই প্রতিরোধ করা। অন্যটি আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করা। দুটো ক্ষেত্রেই আমাদের ব্যর্থতা পাহাড় সমান। তবে তুল্য আলোচনায় দেখা যাবে চিকিৎসা সেবার চেয়ে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার পাল্লা ভারী। বিষয়টি অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় আমাদের মন্ত্রণালয় প্রধানত স্বাস্থ্যসেবার নামে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করে আসছে। এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাজেট বরাদ্দের প্রধান অংশ খরচ হয় পরিচালন ব্যয়, অবকাঠামো নির্মাণ ক্রয় সম্পন্ন করতে। জীবনযাপনের চলমান বাস্তবতায় প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া স্বাস্থ্য বাস্তবতাকে ধারণ করার সামর্থ্য আমাদের স্বাস্থ্য খাতের নেই। 
          করোনা মহামারীর সংকটকালে পৃথিবীব্যাপি চিকিৎসা স্বাস্থ্য সেবা খাতে গবেষণার বিপুল জোয়ার তৈরি হয়। এইসব গবেষণার প্রধান লক্ষ্য হলো- মানুষের ভয়, ভোগান্তি মৃত্যু কামানো। বাংলাদেশে একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ১১০ টি মেডিক্যাল কলেজ, একটি মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল, আইইডিসিআরসহ আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। করোনা সংকটে এদের কারো (একটি বাদে) কোন গবেষণা  উদ্যোগ দেখা যায়নি। বরং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র(্যাপিড অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি কিট তৈরি) , পাবলিক প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়(্যাপিড টেস্টিং কিট তৈরি) এবং বাংলাদেশ কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইনডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ,বিসিএসআরআই( ভাইরাল ট্রান্সপোর্ট মিডিয়া- VTM তৈরি) এর কার্যক্রমে আমরা উৎসাহ বোধ করেছি। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমুহে গবেষণা কার্যক্রমের দৃষ্টিগ্রাহ্য অনুপস্থিতি এই জাতীয় স্বাস্থ্য খাতের খাতের একটি মৌলিক দূর্বলতা। 
       সারাদেশের মানুষ যখন করোনার ভয়াবহ আক্রমণে সন্ত্রস্ত, মরণাপন্ন এবং উদভ্রান্ত তখন স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে দেশবাসী একদিকে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং অন্যদিকে ক্ষুব্ধ  ক্রোধান্বিত হয়। একটু অক্সিজেনের জন্য, হাসপাতালের একটি শয্যার জন্য মানুষ মারা যাচ্ছে। সেই সময় এই রাষ্ট্রীয় অর্থ তসরূপ করার মতো ঘৃণ্য কর্মে যুক্ত একটি চক্রের  দখলে আমাদের স্বাস্থ্য খাত। 
      আমরা প্রায়শই অনুভব করি দেশের ডাক্তারদের সাথে সাধারণ মানুষের একটি দূরত্ব রয়েছে। আমাদের মনে হয় এদেশে মেডিক্যাল ছাত্রদের ডাক্তার হিসাবে গড়ে তোলার মধ্যে একটি জনবিচ্ছিন্ন ধারা এখনো বহমান।  বিষয়টি স্বাস্থ্যসেবা সেক্টরের একটি প্রণিধানযোগ্য দূর্বলতা।
    ২০২০-২১ সালের বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। এবারে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। গতবছর এর পরিমাণ ছিলো  ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে সেটা কমে আসে ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকায়।বরাবরের মতোই এই বরাদ্দ জিডিপির এক শতাংশের কম।অবশ্য স্বাস্থ্যখাতে করোনাসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় আলাদাভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করতে পারি এই পরিমাণ অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে স্বাস্থ্য খাত অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে। বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় বাজেটে জিডিপির এক শতাংশের কম বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গড়ে উঠেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সামর্থ্য বৃদ্ধির আর কোন বিকল্প নেই।
সবদিক বিবেচনা করে আমরা মনে করি স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাবনার মৌলিক পরিবর্তন দরকার। শুধু বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়ালেই বিদ্যমান স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান হবেনা। একটি মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তন,পরিবর্ধন এবং পূনর্বিন্যাস এখন অপরিহার্য।
     এরকম অবস্থায় আমরা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার পক্ষ হতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন পূনর্বিন্যাসের রূপরেখা তুলে ধরছিঃ----------
. করোনা সংকটে আমরা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চিকিৎসা- নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাস্থ্য সুরক্ষার পর্যায়ে উন্নীত হতে হবে। মানুষের ভালো থাকার সাথে পৃথিবীর অন্য সকল প্রাণ, বৃক্ষ, বায়ু,জল, মাটি,বন,সমুদ্র ইত্যাদি সকলের ভালো থাকা গভীরভাবে সংযুক্ত। প্রকৃতি পরিবেশের একটি সদস্য বা উপাদান অসুস্থ বা দূষিত হলে মানুষের সুস্থ থাকা বিঘ্নিত হয়। তাই মানুষকে সুস্থ রাখতে হলে অন্য সবাইকে সবকিছুকে সুস্থ রাখতে হবে। স্বাস্থ্যকে এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখতে সেই অনুযায়ী কর্ম পরিকল্পনা নির্মাণ করতে হবে। আমরা একে 'সামগ্রিক স্বাস্থ্য( One health)' হিসাবে অভিহিত করবো। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে - বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের মৌলিক দর্শন হবে 'সামগ্রিক স্বাস্থ্য' ভাবনা।
. সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভাবনাকে ধারণ বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজাতে হবে। মন্ত্রণালয় চার ভাগে বিভক্ত হবে। এগুলো হলো--. জনস্বাস্থ্য বিভাগ(  Public health division) .মেডিক্যাল শিক্ষা চিকিৎসা বিভাগ(Medical education and management division) . স্বাস্থ্য পরিকল্পনা সমন্বয় বিভাগ(Health planning and coordination division) . পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ(  Family planning division) প্রতিটি বিভাগের সচিব থেকে সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা সবাইকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাডেমিক যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে। প্রতিটি বিভাগে অভিযোগ পরামর্শ গ্রহনের জন্য একাধিক টেলিফোন নম্বর, পোস্টবক্স, -মেইল ঠিকানা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকবে। দেশের অধিকাংশ মানুষকে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। শিল্প, কৃষি, বন পরিবেশ,খাদ্যসহ মানব স্বাস্থ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছুকে স্বাস্থ্যসেবার সাথে যুক্ত করার কাজটি করবে পরিকল্পনা সমন্বয় বিভাগ। মূলত এই কাজটি এখন স্বাস্থ্যসেবার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। খাবারে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশাবে, তাতে মানুষ অসুস্থ হবে,সেই অসুখ সারাতে হাসপাতাল তৈরি করতে হবে -- এই জাতীয় দুষ্টচক্রের কবলে পতিত আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এরকম দৃশ্যপট পরিবর্তনে পরিকল্পনা  সমন্বয় বিভাগ লাগসই ভূমিকা পালন করতে পারবে। স্থানীয়  চাহিদা প্রয়োজনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
. স্বাস্থ্য খাতে গবেষণাকে অতিগুরুত্ব প্রদান করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার চারটি খাতেই গবেষণার বিষয়টিকে চলমান কার্যকরী প্রতিপন্ন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে গবেষণা কাজে নিয়োজিত রাখতে সম্ভাব্য সব ধরনের সমর্থন যোগাতে হবে।  
. দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে একটি স্বচ্ছ জবাবদিহিতামূলক স্বাস্থ্য প্রশাসন গড়ে তোলার অন্য কোন বিকল্প নেই। এটা করতেই হবে।  
. মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রদের কোর্স- কারিকুলামের মধ্যেই  জনসম্পৃক্ত করার যথেষ্ট কর্ম পরিকল্পনা যুক্ত রাখতে হবে। মেডিক্যাল শিক্ষা কারিকুলামের সাথে দেশী সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। মেডিক্যাল শিক্ষার সব পর্যায়ে গবেষণা বাধ্যতামূলক হতে হবে।
. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মোতাবেক জিডিপির শতাংশ অর্থ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিতে হবে।  এই অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহারের সামর্থ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং সেটা বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি। এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষ সুস্থ না থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন, দালানকোঠা, ব্রিজ ইত্যাদি সবকিছুই অর্থহীন। সভ্যতার সকল আয়োজন মানুষকে ভালো রাখার জন্য। মানুষকে সুস্থ রাখার জন্য রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ভাবনায় বাঁক পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।