হাকালুকি হাওরের ২০ হাজার গাছ হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, ক্ষতিপূরণ আদায় ও লীজ বাতিল কর
 

আজ ২২ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার উদ্যোগে হাকালুকি হাওরে বৃক্ষ নিধনের সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচার করার দাবীতে একটি অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জুম প্লাটফর্মে সকাল ১১ টায়, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে ও পবা’র সম্পাদক পাভেল পার্থ সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন , দৈনিক ইত্তেফাকের বড়লেখা উপজেলার সংবাদদাতা তপন কুমার দাস, দৈনিক দেশরূপান্তরের মৌলভীবাজারের পরিবেশ সংবাদিক রিপন দে, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক (মৌলভীবাজার), লেখক ও সাংবাদিক আকমল হোসেন নিপু,  পবার সম্পাদক ও গ্রিনফোর্স সমন্বয়ক মেসবাহ সুমন, বিশিষ্ট কবি ও লেখক পরিবেশ কর্মি শাহেদ কায়েস, বানিপার সভাপতি প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুস সোবহান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সাধারণ সম্পাদক পবা, প্রমূখ।

 

আলোচনায় বক্তরা বলেন, হাকালুকি হাওরে প্রায় ২০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এটি একটি ভয়াবহ চিত্র। যখন পুরো বিশ্ব আজকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে শঙ্কিত, দেশে-বিদেশে যখন বৃক্ষ রোপনের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে বড়লেখায় হাকালুকি হাওরের মালাম বিলে ২০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হলো! আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। যারা যারা দায়ী তাদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানাই। মালাম বিলের ইজারা যারা নিয়েছেন ইজারার শর্ত ভঙ্গ করার কারণে তাদের ইজারা বাতিল করে তাদের কাছ থেকেই ক্ষতিপূরণ আদায় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।

 

ইজারা প্রথার জন্য যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, হাওরের স্বার্থে ইজারা প্রথা বাতিল করতে হবে। ইজারা প্রথার কারণে হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। দেশের হাওরগুলোতে ইজারা প্রথা বাতিল করে সুন্দর ব্যবস্থাপনা করা গেলে মাছের উৎপাদন ২০ ভাগ বেড়ে যাবে। এই ইজারার মাধ্যমে যে সরকার খুব বেশি রাজস্ব অ্যায় করছে তা কিন্তু নয়। এর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হচ্ছে মানুষ, প্রাণ-প্রকৃতি, ও জীব বৈচিত্র্যের। ইজারা গ্রহণকারীরা হাওরের বাস্তুসংস্থান নিয়ে সচেতন নন। নির্বিচারে জলজ বৃক্ষ নিধনের ফলে হাওরের পাখিদের বিচরণ ও আবাসস্থলের পাশাপাশি খাদ্য নিয়েও সংকট দেখা যাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) এক জরিপ তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, গত দুই দশকে হাকালুকি হাওরে পাখির বিচরণ কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। উন্নয়ন করতে যদি পরিবেশ ও বৈচিত্র্য ধ্বংস হয় তবে তা টেকসই হবে না। হাওরে উন্নয়নের ফলে কি ধরণের বৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে।

 

হাওরের জনপদে প্রতি বছর বজ্রপাতে প্রাণ ঝরছে অসংখ্য মানুষের। জলজ বৃক্ষ জেলে ও কৃষকের বন্ধু। জলাভূমিতে অন্যকোন উদ্ভিদ না হওয়ায় হাওরে বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচাতে জলজ উদ্ভিদগুলো বিশেষ ভুমিকা পালন করে, তাই এসব উদ্ভিদ বাঁচাতে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। হাকালুকি হাওরের হিজল, করচ ও বরুন গাছ বর্ষায় হাওরের ঢেউ ঠেকায় যার ফলে তীরবর্তী বাড়িঘর-রাস্তাঘাট রক্ষা পায়। বর্ষা মৌসুমে মাছের খাদ্য ও আবাসস্থল হয়। যেখানে গাছ কাঁটা হয়েছে সেখানে আবার নতুন করে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হাকালুকি  হাওর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবরোধে বিশেষ অবদান রাখছে।

 

বাংলাদেশের প্রধান চারটি মাদার ফিশারিজ এলাকার অন্যতম হাকালুকি হাওর। হাকালুকি হাওর কে বলা হয় অন্য সব হাওরের রাজধানী। এই হাওরের গুরুত্বপূর্ণ ইকো-সিষ্টেম হলো মিঠা পানির আধার। এখানে শুধু ধান উৎপাদন হয় তা নয়। মিঠা পানির অন্যতম উৎস মাছ।

 

আলোচকগণ আরো বলেন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মৌলিক নীতি হিসাবে সংবিধানে স্বীকৃত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে রক্ষার জন্য, বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সেখানে দেশের হাওর অঞ্চলে ব্যক্তি স্বার্থে নির্বিচারে জলজ বৃক্ষ কাটা হচ্ছে। বক্তারা আলোচনায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন।

 

সুপারিশসমূহ

 

  1. সরকারিভাবে একটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করতে হবে। পরিবেশ মন্ত্রীর নিজ উপজেলার ঘটনা তাই শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হোক।
  2. ইসিএ হিসেবে ঘোষিত হাকালুকি হাওরের বৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় সকল ইজারা বাতিল করতে হবে।
  3. হাওরের জলাভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনায় হাওরবাসী জনগোষ্ঠীকে যুক্ত করতে হবে। জনগোষ্ঠীভিত্তিক সংরক্ষণ উদ্যোগ নিতে হবে।
  4. হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ইকোসিস্টেম বজায় রাখার জন্য হাওরের পানি, উদ্ভিদ, ধান, ভাসমান এবং ক্ষুদ্র অনুজীবদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
  5. যেখানে গাছ কাটা হয়েছে সেখানে আবার নতুন করে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা হোক। গাছ লাগানোর পর প্রতিটি গাছের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।