”ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় মক্কা-মদিনার আদলে কোরবানি ব্যবস্থাপনা চালু কর”
ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় মক্কা-মদিনার আদলে কোরবানি ব্যবস্থাপনা চালু কর”
 
আজ ৫ জুলাই ২০২১, সোমবার, সকাল ১০.০০ টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও সাদাকাহ ফাউন্ডেশন ইউ এস এ - এর যৌথ উদ্যোগে “মক্কা- মদীনার আদলে কোরবানি ব্যবস্থাপনা”-শীর্ষক একটি অনলাইন আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও গ্রিণফোর্স সমন্বয়ক মেসবাহ সুমন এর সঞ্চালনায় উক্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য উপস্থাপন করেন পবার সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুস সোবহান, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. আহমেদ আবুল কালাম, সাদাকাহ ফাউন্ডেশন ইউ এস এ-এর পরিচালক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, নাসফের সভাপতি ও পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান ময়না, পবার সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ রাসেল।
 
আলোচকগণ তাদের বক্তব্যে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার সারাদেশে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা বেড়েছে। সরকারী হিসাবে আশা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি গবাদি পশু কোরবানি হবে। পশু নির্বাচন, পরিবহন, কোরবানির আগ পর্যন্ত পশুটিকে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখা, পশু জবাইয়ের স্থানটির পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় প্রশাসন কে স্বাস্থ্য বিধি মেনে কোরবানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা প্রনয়ণ করতে হবে। সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে সকলকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সংক্রমণ এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসহ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। যাদের সুযোগ আছে, তারা অনলাইনে বা ফার্মে বুকিং দিয়ে পশু কিনতে পারেন। অনলাইনে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কোরবানির উপযুক্ত পশুর কেনাবেচাকে উৎসাহিত করতে হবে। অনলাইনে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের হার যত বাড়বে, মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও তত কমবে। ডিজিটাল প্লাটফর্মকে সহজ, নিরাপদ ও জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।
 
পশু পরিবহন ব্যবস্থাপনাকে সহজতর করতে হবে। পশু ক্রয়, জবাই ও মাংস বিতরণ প্রক্রিয়ায় সমন্বয় করতে কুরবানি ব্যবস্থাপনাকে ক্রমশঃ পবিত্র মক্কানগরীর আদলে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
 
বক্তারা আরো বলেন, একদিকে মুসলিম উম্মাহের ত্যাগের আত্মতুষ্টি, অন্যদিকে উদ্যোক্তা ও খামারিদের বিনিয়োগ এবং কুরবানির সাথে সম্পৃক্তদের করোনা সংক্রমিত হওয়ার ভয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। কোন ভাবেই জনবহুল এলাকায় হাট বসানোর অনুমতি দেয়া যাবে না্। পরিস্থিতিতে সংক্রমণ এড়ানোর জন্য ক্রেতা-বিক্রেতা ও পশুর হাটগুলোর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পরিবারের অনেকে মিলে হাটে পশু কিনতে যাবার উৎসব পরিহার করতে হবে। শহরের বাইরে স্বাস্থ্য বিধি মেনে পশু কোরবানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী কোরবানি করার পদ্ধতি, আদর্শ তুলে ধরে সেটা পুনপুন প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিজের বাড়িতে কোরবানি না দিয়ে সিটি করপোরেশনের নির্দিষ্ট স্থানে বা নিজেদের উদ্যোগে ঠিক করা কোনো দূরবর্তী মাঠ বা খোলা জায়গায় কোরবানির কাজ সম্পন্ন করা ভালো হবে। কোরবানি খোলা জায়াগায় দেওয়া হলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে। করোনা অতিমারির সময়ে ঈদে আগের মতো স্বজনদের বাড়ি বাড়ি মাংস বিলাতে যাওয়া বা ভিড় করে দরিদ্রদের মধ্যে মাংস বিতরণ এড়িয়ে চলতে হবে। যথাসম্ভব ভিড় ও জনসমাগম এড়িয়ে কাজগুলো করতে হবে।
মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এখনি কোরবানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করে ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। গরুর হাট বা কোরবানির বর্জ্য সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করলে তা থেকে জৈব সার করা যাবে এবং এটি সুফল বয়ে আনবে। কোরবানির পর একই ভবন বা এলাকার বেশ কয়েকটি পরিবার মিলে একটি এলাকা বা সোসাইটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যেমন, সবাই মিলে বর্জ্য অপসারণের জন্য লোক ঠিক করা যেতে পারে যারা কোরবানির পর পরই বর্জ্য সরিয়ে নিয়ে যাবে। এতে বর্জ্য অপসারণ দ্রুততর হয় বলে পরিবেশের উপর তেমন প্রভাব পড়ে না। জবাই কৃত পশুর গোবর ও উচ্ছিষ্ট আলাদা করে খোলা ভাবে না ফেলে সেগুলো ব্যাগে ভরে নির্ধারিত স্থান যেমন নিকটস্থ ডাস্টবিন বা কন্টেইনারে ফেলতে হবে। সেখান থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ বর্জ্য সহজেই সরিয়ে নিতে পারে।
 
বক্তারা বলেন, মক্কায় যেভাবে স্লটারিং হাউজের মাধ্যমে কম খরচে অল্প সময়ে সুন্দর ও সুষ্ঠু কুরবানী ব্যাবস্থাপনা হয় তা আমাদের দেশেও অনুসরণ করা সম্ভব। মক্কার আদলে কুরবানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলা হলে সহজেই বর্জ্য অপসারণ সম্ভব। এই জন্য সরকার মক্কা-মদিনার মডেলটি বিস্তারিত জেনে আমাদের দেশের উপযুক্ত করে ব্যাপক প্রচারের আয়োজন করতে পারেন। আলোচনা থেকে বক্তারা কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন।
সেগুলো হলো-
• ধর্মীয় মূল্যবোধ বিবেচনায় রেখে করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর নিয়ম মেনে কোরবানি ব্যবস্থাপনা করতে হবে। প্রত্যেক এলাকার মসজিদের ইমাম, সরকারী-বেসরকারী কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, সমাজকর্মিগণে সহযোগিতায় কোরবানির এক সপ্তাহ আগে থেকেই কোরবানি করা, মাংস বন্টন, বর্জ্য নিষ্কাশন বিষয়ে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচারণায় অংশ নিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
• কোরবানি ঈদের সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতির যোগসূত্র অনেক বেশি। কোরবানির পশু পরিবহন ব্যবস্থাপনাকে সহজতর করতে হবে।
• সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেই পশুর হাট ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পশুর হাট বসানোর জন্য গণমাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে।
• বর্তমান পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল পশুর হাট ভালো বিকল্প ব্যবস্থা, কোরবানির পশু কেনাবেচা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম যতটা সম্ভব অনলাইনভিত্তিক করতে উৎসাহিত করতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফরমে কেনাবেচার জন্য সঠিক গাইডলাইনৈ তৈরী করতে হবে।
• সমাজের প্রত্যেককে ধর্মীয় মূল্যবোধের রক্ষার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেতন করতে হবে। নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাই এবং জনদুর্ভোগ কমাতে কোরবানি দেওয়ার পর পরই দ্রুত সময়ের মধ্যে বর্জ্য অপসারণ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
• পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বর্জ্য ও পৌর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সর্ম্পকিত আইন ও বিধিমালার কার্যকর প্রয়োগ করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারকে কুরবানি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা করতে হবে।
• মক্কা মদিনার আদলে কুরবানি করা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জন সচেতনতা ও জনদায়িত্ববোধের সৃষ্টি করার জন্য সরকারী উদ্যোগে আলেম-ওলামাদেরকে এই কাজে সংযুক্ত করতে হবে।