পর্বতারোহী ও সাইক্লিস্ট রেশমা নাহার রত্না'র ঘাতকের বিচার ও নিরাপদ সাইকেল লেনের দাবি

"পর্বতারোহী সাইক্লিস্ট রেশমা নাহার রত্না' হত্যাকাণ্ডের অগ্রগতি ও করণীয় এবং সাইকেল লেনের দাবী" শীর্ষক অনলাইন আলোচনা সভার আয়োজন করেছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সহ সমমনা ৭ টি সংগঠন । 

 

আজ মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) সকাল ১০ টায় এই ভার্চুয়াল আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান এর সভাপতিত্বে এবং পবার সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালনায়; বাংলাদেশ টুরিজম এক্সপ্লোরার এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান  মাসুদুল হাসান জায়েদী'র সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়।

 

এতে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের প্রথম নারী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার, ডাব্লিউ বিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারি, নিহত রত্নার ভাই শাহ আলম, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, গ্রীনফোসের্র  সমন্বয়ক মেসবাহ সুমন, ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয় সাইক্লিং ক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান, সাইক্লিস্ট ও পরিবেশ কর্মী  নওরিন ওশিন, আইনজীবী ও পবা'র সম্পাদক সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন, ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের প্রকল্প কর্মকর্তা সামিউল হাসান সজীব,কবি ও লেখক কামরুজ্জামান ভুঁইয়া,  বাংলাদেশ সাইক্লিং ও হাঁটা জোটের ইসি সদস্য মোঃ শাহরিয়ার নিশু ও সাউথ ঢাকা সাইক্লিস্ট ক্লাবের প্রতিনিধি মো: জাহিদ। 

 

পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার বলেন - একটি পরিবার থেকে যখন কেউ সাইকেল চালাতে বাইরে যায় তখন পরিবারের লোকজন দূচিন্তা করে এ্যাকসিডেন্ট হবার ভয়ে। কারন আমাদের রাস্তাঘাট সাইকেল চালানোর জন্য উপযুক্ত নয়। সাইকেল বাহনটিকে নি¤œশ্রেনির লোকজনের বাহন হিসাবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। ধীর গতির এই বাহনকে সম্মান জানানো এবং সাইকেল চালনাকে প্রতিষ্ঠিত করে সাইকেল লেন করা প্রয়োজন। রত্নার দূর্ঘটনার তদন্ত ও সুষ্ঠ বিচার দ্রুত হওয়া জরুরী। তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতি সাইকেল চালনার আহ্বান জানান।

 

ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারি বলেন - সাইকেল লেন ও নেটওয়ার্ক করতে হবে। সাইকেল ব্যবহার বৃদ্ধি এবং এর সুবিধাগুলো মিডিয়ায় প্রচার করতে হবে। পলিসি এ্যাভোকেসি করা এবং সাইকেলের উপর কর আরোপ না করা।

 

আইনজীবি ও পবা’র সম্পাদক সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন- স্থানীয় সরকার আইন, সড়ক পরিবহন আইনে সাইকেল লেন ও পথচারী সুরক্ষা নিশ্চিতে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও করনীয় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা উচিত। এছাড়া যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে একটি এ সংক্রান্ত সেল প্রতিষ্ঠা জরুরী।

 

পবা’র চেয়ারমান আবু নাসের খান বলেন- যাতায়াতের অন্যতম বাহন হিসাবে সাইকেল কে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা এখন  সময়ের দাবী। যাতায়াত নীতিমালায় সাইক্লিং পরিপন্থী ও নিরুসাহিত করার মত উপাদান গুলোকে চিহ্নিত করে সেসব দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে। সাইক্লিং গ্রুপগুলোকে উৎসাহিত ও সহায়তা করা। যারা সড়ক  দূর্ঘনায় আহত/ নিহতদের পাশে দাঁড়ানো এবং আইনগত সহায়তা প্রদান করতে হবে। যে সমস্ত  সাইকেল লেন দখল  হয়েছে সেগুলোকে দখল মুক্ত করার জন্য কাজ করতে হবে। রত্না নিহত হবার  র্ঘটনাটি একটা নিশ্চিত হত্যাকান্ড। ঘাতক এখানে রত্নাকে ধাক্কা দিয়েছে, দূর্ঘটনার স্থান থেকে  পালিয়ে গেছে তাকে সাহায্য না করে।

 

নিহত রত্নার মেজো ভাই শাহ আলম বলেন-ঘাতক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রথম শ্রেনির কর্মকর্তা। নগরের এই প্রশস্ত রাস্তায় নিধারিত গতিসীমা অতিক্রম করে ঘাতক সাইকেল আরোহীকে গাড়ী ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তাই এটা নিশ্চিত হত্যাকান্ড। তিনি তার বোনের হত্যাকারীর দৃর্ষ্টান্তমূলক বিচার দাবী করেন। 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাইক্লিং ক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান বলেন- সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুটা এখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দুদিন পর আমরা এইগুলো ভুলে যাই। কারন এসব দূর্ঘটনায় সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচার হয় না। শুধু রত্না নয় এরকম আরো অনেক দূর্ঘটনাই ঘটে, যার বিচার কার্য সম্পন্ন হয় না। আইনের শত মারপ্যাঁচ এর ফলে আসামী জামিন পেয়ে যায়। মানুষের ভিতরে চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে যেন তারা ভালো কাজের জন্য এগিয়ে আসে। 

 

বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস বলেন-সাইক্লিংস্টদের দূর্ঘটনার পরিসংখ্যান তৈরি করা অত্যন্ত জরুরী।

 

পরিবেশকর্মী ও সাইক্লিস্ট নওরিন ওশিন বলেন-সাইকেল পার্কিং এর নিরাপত্তা দেয়া এবং গাড়ী, রিক্সা, সিএনজি পার্কিং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আইনের নীতিমালায় সাইকেল আরোহীর নিরাপত্তা দান এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে।

 

অন্যান্য বক্তারা বলেন-তরুণদের উৎসাহিত করণে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত শহরের সাইকেল লেনের ভিডিও ক্লিপ প্রচার করা। যাতে করে স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা বাহন হিসাবে সাইকেল ব্যবহার করে। পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে সাইকেল সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয়। একই সঙ্গে এটি স্বাস্থ্যসম্মত ও সাশ্রয়ী। এছাড়া নগরে যানজটের ভোগান্তি থেকে বাঁচতেও সাইকেলের জুড়ি নেই। আর বর্তমান করোনা প্রেক্ষাপটে গণপরিবহণ এড়াতে সাইকেল হতে পারে ব্যক্তিগত বন্ধুবাহন। অবশ্য নগরে স্বাস্থ্যসচেতন অনেকেই যাতায়াতে নিয়মিত সাইকেল ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে তরুণদের সাইকেল ব্যবহারে আগ্রহ বেশি লক্ষণীয়।

 

বিশ্বে নেদারল্যান্ডসে মাথাপিছু সর্বাধিক বেশি সাইকেল ব্যবহার করা হয়। তবে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনকে বিশ্বের সবচেয়ে সাইকেল বান্ধব শহর হিসেবে গণ্য করা হয়। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক ও জার্মানীতে সবচাইতে বেশি সাইকেল ব্যবহৃত হয়। এসব দেশে সাইকেল চালানোর

 

 

জন্য রাস্তার পাশে পৃথক লেন রয়েছে। তবে ইদানিং জাপান, চীন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে ছোটো দূরত্ব যাতায়াতের জন্য সাইকেল চালানোতে সরকারিভাবে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। অফিসযাত্রী কিংবা স্কুল-কলেজে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগও দিচ্ছে

 

কোনো কোনো শহর। এসব দেশে সড়ক পরিবহণের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাহন হচ্ছে বাইসাইকেল। এটি তৈরি হয়েছে সহজ জ্যামিতিক পদ্ধতিতে, চালককে সড়কের আঘাত থেকে রক্ষা করতে এবং কম গতিতে চালানো সহজ করতে। এসব দেশে শিশুদেরকে সাইকেল চালানোর দক্ষতা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক স্কুল ও পুলিশ ডিপার্টমেন্ট শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, বিশেষ করে তাদেরকে সড়কের নিয়ম কানুন গুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া হয়, যেহেতু তারা সাইক্লিস্ট হওয়ার জন্য ইচ্ছা পোষণ করে। বয়স্ক সাইক্লিস্টদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যও কিছু সেচ্ছাসেবী সংস্থা আছে।

 

আমরা পবা থেকে সাইকেল লেন ব্যবহারের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করে পরিবেশ বান্ধব এই বাহনের জনপ্রিয়তা বাড়াতে শুধু ঢাকা নয়; অন্যান্য বিভাগীয় শহরের রাস্তাগুলোতে আলাদা করে বাইসাইকেল লেনের দাবি জানাচ্ছি। পবা’র পক্ষ থেকে পৃথিবীর অনেক দুর্গম পর্বত জয় করা রত্নার এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার, অপরাধীর সর্বোচ্চ কঠোরতম শাস্তির দাবি জানাচ্ছি এবং সেইসাথে সাইক্লিস্টদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে দেশে সাইকেল লেইনের দাবি জানিয়ে পবা'র সুপারিশ সমূহ নিম্নে বর্ণিত হলো-

 

১. সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত রত্না হত্যার বিচার কার্য সম্পন্ন করে অপরাধীর কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করা।

২. সম্পন্ন সাইকেল নেটওয়ার্ট তৈরি যেমন- বাসা থেকে কর্ম স্থান বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত করতে হবে।

৩. সাইকেল বান্ধব অবকাঠামো তৈরি।

৪. সাইকেল আরোহীদের আরো সচেতনভাবে সাইকেল চালানোর জন্য সর্তক করা এবং নিয়ম মেনে সাইকেল চালাতে উৎসাহিত করা।

৫. সাইকেল লেন ব্যবহার করার প্রতি সচেতনতা সৃষ্টি করা।

৬.পরিবেশবান্ধব এই বাহনটি ব্যবহারের সুবিধা নিয়ে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাইক্লিং এর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

৭. দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য নিরাপদ সড়ক ও সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করা।

৮. যে স্বল্প পরিমাণ সাইকেল লেন আছে তা দখলমুক্ত করে নিরাপদ সাইক্লিং করার নিশ্চয়তা প্রদান করা। 

৯. পারিবারিকভাবে সন্তানকে সাইকেল চালানোয় উৎসাহিত করার জন্য জনমত গড়ে তোলা।