নামসর্বস্ব মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নয়; মেডিকেল বর্জ্যরে কার্যকর ব্যবস্থাপনা চাই নামসর্বস্ব মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নয়; মেডিকেল বর্জ্যরে কার্যকর ব্যবস্থাপনা চাই
একটি সুষ্ঠ মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যত অনুপস্থিত। এই অনিয়ন্ত্রিত মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সাধারন বর্জ্যরে সাথে মিশে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে বিপর্যয় রোধে একটি কার্যকর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরী। তাই পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নাসফ সহ ১৩টি সংগঠনের উদ্যোগে আজ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, শনিবার, সকাল ১১.০০টায়, জাতীয় জাদুঘরের সামনে “নামসর্বস্ব মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নয়; মেডিকেল বর্জ্যরে কার্যকর ব্যবস্থাপনা চাই” -দাবীতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান -এর সভাপতিত্বে ও পবা’র সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালনায় উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, নাসফ-এর সাধারণ সম্পাদক মো: তৈয়ব আলী, সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কে এম সিদ্দিক আলী, সহ-সভাপতি অলিভা পারভীন, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন  কমিটি এর নিবার্হী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগ এর সভাপতি নাজিম উদ্দীন, বিডিক্লিক এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি এর সদস্য সচিব মেনন চৌধুরী, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশন এর মুখপাত্র মো: ইমরান হোসাইন,  আলোকিত বন্ধু সংঘ এর সাধারন সম্পাদক  মো: রনি, হিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জেবুন নেসা, সুবন্ধন এর সভাপতি মো: হাবিবুর রহমান, মৃত্তিকা এর খাদিজা খাতুন, গ্রিণফোর্স এর আহসান হাবিব, ক্যামেলিয়া চৌধুরী, শাকিল রেহমান, কবি কামরুজ্জামান ভ’ইয়া প্রমুখ।
 
বক্তারা বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা  শহর, পৌরসভায় মেডিকেল বর্জ্য একটি বড় সমস্যা। যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনাকালে এই সমস্যা আরো প্রকটভাবে দৃশ্যমান। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য রাজধানীর চার পাশের নদীসহ হাসপাতালগুলোর সামনের খোলা ডাষ্টবিন কিংবা নর্দমায় ফেলা হচ্ছে। রাজধানীর মেডিকেল বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা থেকেই সারা দেশের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
 
বক্তারা আরও বলেন, একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মেডিকেল বর্জ্যরে যথাযথ ব্যবস্থাপনা কৌশল ও কার্যকর বাস্তবায়ন এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের কলেবর বেড়েছে, সেইসাথে ডিসপোজিবল/একবার ব্যবহারযোগ্য চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ফলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। তন্মধ্যে অত্যন্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূণ মেডিকেল বর্জ্যের তালিকায় রয়েছে ব্যবহৃত সূঁচ, সিরিঞ্জ, রক্ত ও পুঁজযুক্ত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, টিউমার, ঔষধের শিশি, রক্তের ব্যাগ, স্যালাইনের ব্যাগ, মেয়াদোর্ত্তীণ ঔষধ, ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রভৃতি দ্রব্যাদি। তাছাড়া পয়:নিষ্কাশন লাইনের সাথে পানির পাইপের সংমিশ্রণেও সংক্রামক রোগের ব্যাপক বিস্তার হয়। এই বর্জ্যরে বেশির ভাগই সংক্রামক, এগুলোর মাধ্যমে রোগের সংক্রমন আশংকাজনক হারে বাড়ছে। টাইফয়েড, কলেরা, যক্ষ্মা, আমাশয়, ডায়রিয়া, এইচ আই ভি, বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, জন্ডিস, নিউমোনিয়া ও এন্টিবায়োটিক রেজিষ্ট্যান্ট ব্যকটেরিয়ার বিস্তার  জনিত জটিলতা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হচ্ছে জনসাধারণ। তাছাড়াও হাসপাতাল থেকে নির্গত পানির মাধ্যমে সালমোনেলা এবং শিগেলা প্রজাতির জীবানু ছড়ায়। এ বর্জ্য পানিতে বিদ্যমান অতিমাত্রায় বিষাক্ত ধাতু ও রাসায়নিক উপাদান যেমন ট্রাইক্লোরো ইথিলিন, সীসা, আর্সেনিক, বেনজিন, তামা, জিংক, ক্যাডমিয়াম, নিকেল ইত্যাদি যা চর্মরোগসহ মারাত্মক ধরনের রোগের সৃষ্টি করতে পারে। আর অনিয়ন্ত্রিতভাবে এন্টিবায়োটিকসহ নানা উপাদান পানি ও মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে।
 
স্বাস্থ্য অদিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রাথমিক, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরের সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৪৫টি এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ৯৪টি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী  বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৪৪৫২টি, ক্লিনিক ২২৩৬টি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১০২৯১, সর্বমোট ১৬৯৭৯টি। ২০০০ সালে ছিল যথাক্রমে ১১২৫টি, ৬৩৩টি, ১৭৭৮টি, সর্বমোট ৩৫৩৬টি। দুই দশকে হাসপাতাল বেড়েছে চারগুণ, ক্লিনিক সাড়ে তিনগুণ, ডায়গনোস্টিক সেন্টার প্রায় ছয়গুণ, মোট বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা মোট ১৭৭১৮টি। সরকারি হাসপাতালে বেড রয়েছে ৫২৮০৭টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ১০৫১৮৩টি। 
 
প্রিজম নামক একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ঢাকায় ১২০০টি হাসপাতালের সাথে চুক্তিবদ্ধ। করোনার আগে এ সংস্থা প্রতিদিন ১৪ টন বর্জ্য সংগ্রহ করতো। গড়ে প্রতিটি হাসপাতাল থেকে ১১ দশমিক ৭ কেজি। বর্তমানে প্রতিদিন ৭-৮ টন বর্জ্য সংগ্রহ করছে। অথচ একটি হিসাব মতে ঢাকায় দৈনিক নূনতম ২০৬ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। হাসপাতালগুলো  তাদের বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করছে না- এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী হাসপাতাল ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে মেডিকেল বর্জ্যরে নিরাপদ নিষ্কাশন ব্যবস্থা। বাংলাদেশে হাসপাতাল ডিজাইনের ক্ষেত্রে যা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কোনো মাথা ব্যথা নেই। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বর্তমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেয়া অত্যন্ত জরুরী।
 
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর আওতায় মেডিকেল বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের স্বস্ব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, গাফিলতি ও তদারকির অভাব এর অন্যতম কারণ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে উৎসে বর্জ্য পৃথকীকরণ হচ্ছে না। যদিও মেডিকেল বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী পৃথকীকরণ বাধ্যতামূলক। এছ্াড়াও হাসপাতালে নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মীদের চিকিৎসা বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। একটি সুষ্ঠ মেডিকেল ব্যবস্থাপনা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে অত্যাবশ্যক। 
 
দাবীসমূহ : 
 
১. মেডিকেল বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮ অনুসারে বজ্য সমূহ উৎসেই যথাযথভাবে পৃথক করে সঠিকভাবে ডিস্পোজাল করতে হবে। এখানে কোন  প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করলেও, দায় থাকবে বর্জ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানেরই।
২. স্বাস্থ্য শিক্ষার সব শাখায় বিশেষ করে এমবিবিএস, নার্স এবং মিডওয়াইফ কারিকুলামে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা ও হাসপাতালে নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. স্বাস্থ্য বাজেটে মেডিকেল বর্জ্যরে নিরাপদ নিষ্কাশনের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।
৪. পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সম্পৃক্ত করে এবং  জনস্বাস্থ্যসহ পরিবেশ বিপর্যয়কে গুরুত্ব দিয়ে মেডিকেল বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮  সংশোধন করতে হবে।
৫. সকল মেডিকেল বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার লক্ষে ক্ষতিকারক সকল উপাদান সমূহ চিহ্নিত করে তা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে গবেষণার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।