পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ চাই
প্লাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব চারপাশ। পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ার পর গত দুই দশকে শুধু রাজধানীতেই প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়েছে ৩ গুণের বেশি। অথচ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার কিংবা পলিথিনের বিকল্প তৈরিতে নেই কোনো উদ্যোগ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গলদ ও নগরবাসীর অসচেতনতায় ভয়ংকর পরিণতির পথে এগোচ্ছে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ। তাই পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নাসফ সহ ১৪ টি সংগঠনের উদ্যোগে আজ ৯ অক্টোবর ২০২১, শনিবার, সকাল ১১.০০টায়, জাতীয় জাদুঘরের সামনে “পলিথিন-প্লাস্টিকের ছড়াছড়িতে হুমকির মুখে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য; পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে চাই কার্যকর উদ্যোগ”-দাবীতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান -এর সভাপতিত্বে ও পবা’র সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালনায় উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন নাসফ-এর সাধারণ সম্পাদক মো: তৈয়ব আলী, সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কে এম সিদ্দিক আলী, সহ-সম্পাদক মোঃ সেলিম, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটি এর নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগ এর সভাপতি নাজিমউদ্দীন, বিডিক্লিক এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, সুবন্ধন এর সভাপতি মো: হাবিবুর রহমান, গ্রিণফোর্স এর আহসান হাবিব, বানিপার সভাপতি প্রকৈা. মো: আনোয়ার হোসেন, মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের মহাসচিব মাহবুল হক, শাকিল রেহমান, ইয়ুথ সানের সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পি, পরিষ্কার ঢাকার প্রধান সমন্বয়ক মোঃ শাজাহান, বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট সাইক্লিস্ট এর সমন্বয়ক রোজিনা আক্তার প্রমুখ।
 
বক্তারা বলেন, সরকারকে দ্বৈত নীতি ত্যাগ করতে হবে। কারণ সরকার একদিকে পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করার কথা বলছে; অন্যদিকে পাটকলগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে সাধারণ মানুষ পাটের ব্যাগ ব্যবহারে দিন দিন উৎসাহ হারাচ্ছে। 
 
বক্তারা আরো বলেন, একটি মাত্র প্লাস্টিক ব্যাগ মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে প্রায় এক হাজার বছর। সে জন্যই প্লাস্টিক বর্জ্য কিভাবে রিসাইকেল করা যায়- তা বিজ্ঞানীদের কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ। সারা দুনিয়াতেই প্লাস্টিক বিশেষ করে একবার ব্যবহৃত হয় এমন প্লাস্টিক পণ্য এক বিশাল সমস্যা।
 
রাজধানীর খাল-নর্দমা পরিষ্কার করে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় প্লাস্টিকের বোতল। কোমল পানীয়ের বোতল থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই যে পাওয়া যায় না। কোমল পানীয়র বোতল ছাড়াও কসমেটিকসের মোড়ক, নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যসহ পলিথিন ব্যাগ পাওয়া যায়। আর এ কারণেই বর্ষা এলেই রাজধানীজুড়ে জলজট তৈরি হয়। ব্যবহারের পর এসব জিনিস বিভিন্ন জলাশয়ে ও যত্রতত্র ফেলে দেওয়ায় পরবর্তী সময়ে তা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। সেখান থেকে জলজ প্রাণী তা গ্রহণ করছে। এসব প্রাণীর মাধ্যমে তা আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। যার ফলে দিন দিন তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। ক্ষতিকারক জেনেও মানুষের মধ্যে দিন দিন পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার এবং অব্যবস্থাপনার হার ক্রমেই বাড়ছে। 
 
রাজধানীর বর্জ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায় রাজধানীতে ২০০৫ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৭৮ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হতো। সেখানে ২০২০ সালের হিসাব দাঁড়িয়েছে ৬৪৬ টনে। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় এক হাজার দুই শত কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরী হচ্ছে। এগুলোর বেশীর ভাগই পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটির বেশী পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশী টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ পলিথিনের হলেও কাপড়ের ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। 
    
বাংলাদেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, অনেক দেশে এক মাসে সে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য হয় না। পলিথিন ও প্লাস্টিক যে পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা এখানকার বেশির ভাগ মানুষই জানে না। বাংলাদেশের জলে-স্থলে বর্তমানে ৬৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। প্রতিদিন এর সঙ্গে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টন করে যোগ হচ্ছে। এর ১৭ শতাংশই প্লাস্টিক জাতীয়। এসব বর্জ্যরে অর্ধেকই সরাসরি পানিতে বা নিচু ভূমিতে ফেলা হয়। বাংলাদেশে যেখানে জৈব বর্জ্য বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যরে বৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ শতাংশ। দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে। সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট জার্নালে গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, দেশের পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ৮৭ শতাংশই পরিবেশবান্ধব সঠিক ব্যবস্থাপনায় নির্মূল করা হচ্ছে না।  
 
আমাদের দেশে উন্নত বিশ্বের পচনশীল-অপচনশীল দ্রব্য আলাদাকরণের ব্যবস্থা নেই। এর সঙ্গে যোগ হওয়া নাগরিক অসচেতনতা পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে। রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে পচনশীল ও অপচনশীল দ্রব্য ফেলার জন্য আলাদা ঝুড়ি রয়েছে। কিন্তু নাগরিকরা যার যেখানে ইচ্ছা সেখানেই ময়লা ফেলেন। ডাস্টবিনের চেয়ে বরং ঝিলের পাড়ে ও পানিতে বেশি ময়লা দেখা যায়। মহামারি করোনার প্রার্দুভাবের কারণে দেশব্যাপী ‘ওয়ান টাইম’ প্লাস্টিক চায়ের কাপ ব্যবহার শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে ঝুঁকি বেড়েছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের। এই পরিস্থিতিতে প্লাস্টিক কাপের ব্যবহার বন্ধ করার প্রয়োজনীয় দাবি উঠেছে। 
 
বাংলাদেশ পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধকারী প্রথম দেশ হিসাবে বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের বিধান করা হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এমন বাস্তবতায় ওই আইন কার্যকরে এ বছরের জানুয়ারিতে ফের সেই আইনি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে এক বছরের সময় বেঁধে দিয়েছে উচ্চ আদালত। পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৮৯৭টি অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানে ৫ হাজার ৯৫৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২০ কোটি ৮১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। পলিথিন ব্যবহারের কারণে ৯১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। 
 
পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও নেই কোনো বিকল্প পণ্য। পাটের ব্যাগকে জনপ্রিয় করতে পারেনি সরকার। প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ ঠেকাতে পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করাটা অপরিহার্য মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে বহু অবৈধ কারখানা গড়ে উঠেছে যেখানে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক থেকে নতুন পণ্য উৎপাদন করা হয়। কিন্তু এ প্লাস্টিক শিল্প ঘিরে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। পাট থেকে পলিব্যাগ, ফেলে দেওয়া বোতল থেকে ফ্লেক্স কিংবা পলিব্যাগ পুড়িয়ে জ্বালানি তেল উদ্ভাবনের মতো বিষেয়গুলোকে খুব একটা আমলে নেয়নি সরকার। এমনকি এ নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণারও উদ্যোগ নেই। বাস্তবতা হলো-যেহেতু বাংলাদেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের প্রচুর চাহিদা তাই এটা বন্ধ করা যাবে না। বরং এর রিসাইক্লিং কিংবা বিকল্প নিয়ে ভাবতে হবে। তাতে এ খাতে ব্যাপক কর্মস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে। 
 
দাবীসমূহ: 
 
১. পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। 
২. পলিথিন শপিং ব্যাগ ও টিস্যু ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 
৩. নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 
৪. পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা ইত্যাদি সহজলভ্য করা এবং এগুলো ব্যবহারে জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। 
৫. বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানীকৃত পলি প্রোপাইলিন পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। টিস্যু ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল আমদানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 
৬. পরিবেশ অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। 
৭. প্লাস্টিক বর্জন, হ্রাস, পুনঃব্যবহারের ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
৮. প্লাস্টিক বর্জন, হ্রাস, পুনঃব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার লক্ষ্যে ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনে নাগরিকদের সচেষ্ট হতে হবে।
৯. প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলায় সরকার বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।