পলিথিন ব্যাগে বাজার সয়লাব, জনস্বার্থে চাই আইনের কঠোর প্রয়োগ
পরিবেশের গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ আইন দেশের জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে। কিন্তু পলিথিন নিষিদ্ধের আইন বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, মনিটরিং, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ-এর অভাবে কুটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে, সাম্প্রতিক সময়ে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। 
 
এ সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ১২ নভেম্বর ২০১৬, শনিবার, সকাল ১১.০০ টায় শাহবাগের চারুকলা অনুষদের সামনে “পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন কর” দাবীতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’সহ ১৮টি পেশাজীবী, পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠন এ মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করে।
 
পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য রাখেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটির সভাপতি বুরহান উদ্দিন আহমদ, ইয়থ সানের সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পী, সুবন্ধন সামাজিক সংগঠনের সভাপতি হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ পরিবেশ বান্ধব সংগঠন এর সাধারণ সম্পাদক কাজী মুজাহিদ হাসেম, সাংগঠনিক সম্পাদক রতন মজুমদার, কেরানীগঞ্জ শপিং ব্যাগ ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লি: এর সাধারণ সম্পাদক মো: আবু বক্কর ছিদ্দিকসহ আরও অনেকে। 
 
বক্তারা বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নিষিদ্ধ পলিথিন। এ ছাড়া কাপড়ের মতো দেখতে এক ধরনের রঙিন পলিথিন টিস্যু ( যা চায়না টিস্যু নামে পরিচিত) ব্যাগে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরীতে বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানীকৃত পলি প্রোপাইলিন বেআইনীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 
 
বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষণায় টিস্যু ব্যাগে পলিথিনের মতো পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। নিষিদ্ধ পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ফলে কাগজ, পাট ও কাপড়ের ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমে গেছে, ফলে হাজার হাজার ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বিশেষ করে নারী-শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।
 
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধের আইন দেশের জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নের ফলে পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে আইনটি কার্যকর হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কোন কার্যকর তৎপরতা এবং মনিটরিং না থাকায় নিষিদ্ধ পলিথিন এবং টিস্যু ব্যাগে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে।
 
মানববন্ধনের সভাপতি ও পবার সাধারণ সম্পাদক আবদুস সোবহান বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরীর প্রায় এক হাজার দুই শত কারখানা রয়েছে। এগুলোর বেশীর ভাগই পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক। পুরান ঢাকার অলি-গলিতে রয়েছে প্রায় তিন শত কারখানা। বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানীকৃত পলি প্রোপাইলিন অবৈধভাবে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরীতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় এক কোটি ৪০ লাখের বেশী পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। 
 
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ৬ক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার সকল বা যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরী অন্য কোন সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে, এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ধারা ৬ক এর অধীন প্রদত্ত নির্দেশ লংঘনক্রমে বর্ণিত সামগ্রী (ক) উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ -এ প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক দুই বছর কারাদন্ড বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড; পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন দুই বছর, অনধিক দশ বছর কারাদন্ড বা অন্যূন দুই লক্ষ টাকা, অনধিক দশ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড এবং (খ)  বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার -এ অনধিক এক বছর কারাদন্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।
 
বাংলাদেশ পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০ (২০০২ সনের ১০ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ২(খ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পলিথিন শপিং ব্যাগ সংক্রান্ত অপরাধসমূহের ব্যাপারে অনুসন্ধান, কোন স্থানে প্রবেশ, কোন কিছু আটক, আনুষ্ঠানিক তদন্ত ও অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ এবং প্রয়োজনবোধে পরিবেশ আদালত বা স্পেশাল ম্যাজিষ্ট্রেট এর আদালতে পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০ (২০০২ সনের ১০ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) অনুযায়ী মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের এস আই/সমপর্যায় হতে এ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ পর্যন্ত; মেট্রোপলিটন বহিভর্’তএলাকায় এস আই/সমপর্যায় হতে সহকারী পুলিশ সুপার পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তাগণকে ০৪ মে ২০০২ তারিখের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উক্ত আইনে সংজ্ঞায়িত “পরিদর্শক” এর ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সরকার পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৩ নং আইন) (২০১৩ সনের ৩৮ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) জারী করে। আইনে ধান, চাল, গম, ভুট্রা, চিনি ও সার মোড়কীকরণে ১০০% পাটজাত বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। 
 
বিশ্বব্যাপী বছরে প্রায় ৫০০(পাঁচ শত) বিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে, যা প্রতি মিনিটে ১(এক) মিলিয়ন। প্রতি বছর মার্কিন ক্রেতাদের হাতে ১০০ বিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য ও শহরের গ্রোসারী মার্কেট এবং শপিং মলে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে সেখানে বর্তমানে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে, যা আগামী ৫ বছরে ৫০ গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এ চাহিদার শতকরা মাত্র তিন থেকে পাঁচ ভাগ রফতানি করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধুমাত্র আমেরিকায় পাটের ব্যাগ রফতানি করে বছরে ১ (এক) বিলিয়ন মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব।
 
মানববন্ধনে দাবি সমূহ:
১. পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা, পলিথিন শপিং ব্যাগ ও টিস্যু ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করা এবং পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করা।
২. নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, পরিবহন ও ব্যবহারকারীদের বিদ্যমান আইন আওতায় আনয়ন করা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
৩. পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা  ইত্যাদি সহজলভ্য করা এবং এগুলো ব্যবহারে জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করা।
৪. পলিথিন শপিং ব্যাগ ও টিস্যু ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল আমদানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৫. পরিবেশ অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
৬. পরিবেশ অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।