নগর যাতায়াত ব্যবস্থায় হাঁটা ও সাইকেলের গুরুত্ব
নগর যাতায়াত ব্যবস্থায় হাঁটা ও সাইকেলের গুরুত্ব
 
সৈয়দ মাহবুবুল আলম
 
স্বাস্থ্য রক্ষা, শব্দ, বায়ু ও পরিবেশ দূষণ রোধসহ অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের জন্য নগর জীবনে হাঁটা ও সাইকেলের গুরুত্ব অপরিসীম। নগর জীবনে অবকাঠামোগত কারনে অতিরিক্ত মোটা হওয়া, যান্ত্রিক নির্ভরতা বৃদ্ধি, দূষণ যাতায়াত সমস্যাসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। যান্ত্রিক নির্ভরতার প্রেক্ষিতে বাড়ছে যানজট ও জ্বালানী নির্ভরতা অন্যদিকে বাড়ছে জ্বালানী তেলের মূল্য। আমরা যদি স্বল্প দূরত্বের যাতায়াতে হেঁটে, সাইকেলে চলাচল করি তাহলে একদিকে যেমন গাড়ি নির্ভরতা কমিয়ে যানজট সমস্যা সমাধান সম্ভব অন্যদিকে স্বাস্থ্য, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সম্ভব অর্থ সাশ্রয়। 
 
যানজট, জ্বালানি সংকট, জলবাযূর পরিবর্তন, শব্দ, বায়ু ও পরিবেশ দূষণ, অতিরিক্ত মোটা হওয়া ও নানা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে হাঁটা এবং সাইকেলে চলাচলের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির করা জরুরী। ব্যায়ামের অভাব বা প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিশ্রম না করায় শিশু ও সব বয়সী মানুষের মাঝে অতিরিক্ত মোটা হওয়া, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্তের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট এবং শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য ১ ঘন্টা হাঁটা প্রয়োজন। তাছাড়া প্রতিদিন ৩০ মিনিট অথবা বছরে ২১০০ কিলোমিটার সাইক্লিং করলে ৫০ ভাগ মুটিয়ে যাওয়া, ৩০ ভাগ ব্ল¬াড প্রেসার, ৫০ ভাগ হৃদরোগ, ৫০ ভাগ ডায়াবেটিসের হ্রাস পায়।
 
বিশ্বে পরিবহণ খাতে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারজনিত কারণে ২৫শতাংশ কার্বন নির্গমণ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। পরিবহণ ব্যবস্থায় হেঁটে চলাচল এবং সাইকেলের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে কার্বন নির্গমণ হ্রাস করা সম্ভব। তাছাড়া সাশ্রয়ী যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে সাইকেলের বিকল্প নেই। হাঁটা এবং সাইকেল বছরে যে পরিমাণ জ্বালানী সাশ্রয় করতে পারে তা দিয়ে রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। সঠিক পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করলে ঢাকাসহ সারা দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ হেঁটে এবং সাইকেলে চলাচলে উৎসাহিত হবে, যা শহরাঞ্চলে যানজট কমানোর পাশাপাশি পরিবেশ, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য বিষয়ক নানামূখী সুবিধা অর্জনে সহায়ক হবে।
 
নগর জীবনে হাঁটা, সাইকেলের গুরুত্ব ও চলমান পদক্ষেপসমূহ:
যে কোন নগরীর প্রতিটি মানুষ যাতে স্বাচ্ছন্দে, কম খরচে, নিরাপদে এবং সময়মত যাতায়াত করতে পারে সেজন্য একটি সুষ্ঠু নগর পরিবহণ ব্যবস্থা থাকা জরুরী। এই ব্যবস্থাকে সকলের জন্য কল্যাণকর, টেকসই ও নগরীর অন্যান্য পরিকল্পনার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। হাঁটা, সাইকেলের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন যান্ত্রিক যানবাহনের প্রবর্তন হলেও এমনকি প্রতিটি নগরীতে এখন পর্যন্ত যাতায়াতের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে মানুষ হেঁটে, সাইকেলে চলাচল করছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়াই শুধুমাত্র বিনোদনের জন্যও মানুষ প্রচুর হাঁটাহাঁটি করে এবং সাইকেল চালিয়ে থাকে। ঢাকা শহরও এর ব্যতিক্রম নয়। হেঁটে এবং সাইকেলে চলাচলের ফলে ঢাকাবাসী একই সঙ্গে দুইভাবে উপকৃত হচ্ছে। যাতায়াতের পাশাপাশি ব্যায়ামের সুযোগও পাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ঢাকায় অধিকাংশ মানুষ হেঁঁটে, রিকশায় এবং পাবলিক পরিবহনে চলাচল করে। অধিক হারে যান্ত্রিক যানবাহন ব্যবহারে পৃথিবীর অনেক শহরেই অস্বাস্থ্যকর ও বিরক্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। যা মানুষের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থা  মারাত্মক স্বাস্থ্য সঙ্কট তৈরি করছে। সকলকেই স্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে হাঁটা প্রয়োজন। আনন্দদায়ক এবং নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে অনেকেই হাঁটতে উৎসাহী হবে। এমনকি অল্প দূরত্বে গাড়ি পরিহার করে মানুষ হাঁটার প্রয়াস পাবে।
 
ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রান্সপোর্ট স্টাডিজ (ডিআইটিএস) এর গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে শতকরা ৬০ ভাগ  যাতায়াত সম্পন্ন হয় পায়ে হেঁটে। কত ভাগ সাইকেলেএর কারণ ঢাকায় শতকরা ৭৬ ভাগ যাতায়াত পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে, যার অর্ধেক আবার ২ কিলোমিটারের অধিক নয় (এইচডিআরসি)। কিন্তু নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ঢাকা শহরে মানুষকে হাঁটতে, সাইকেল চালাতে নিরুৎসােিহত করছে। সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া নির্মিত অবকাঠামো, যান্ত্রিক যানের ব্যবহার বৃদ্ধি, ফুটপাত ভেঙ্গে ফেলা, ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং ও কনস্ট্রাকশনের জিনিসপত্র-ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা, রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ এর ব্যবস্থা করাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ আমাদের স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বোপরি হাঁটার অধিকার খর্ব করছে। অথচ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে নগরে হাঁটতে উৎসাহিত করতে ফুটপাত প্রশস্ত করা হচ্ছে।
 
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে নগরকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থায় হাঁটাকে সর্বোচ্চ এরপর ক্রমানুসারে সাইকেল এবং পাবলিক পরিবহণকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। যে কারণে সেসব শহরগুলিতে মানুষ প্রাণবন্ত ও জীবন যাপনের মান অনেক উন্নত। তাছাড়া যান্ত্রিক যানবাহনের সঙ্গে একই লেনে সাইকেলে চলতে অনেকেই নিরাপত্তা বোধ করেন না। সাইকেল নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর রাখার মতো নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। অতএব সাইকেলের জন্য পৃথক লেন, পথ ও স্ট্যান্ড তৈরি করা হলে সাইকেলে চলাচল উৎসাহিত হবে। এছাড়া সাইকেলের উপর কর কমানো, সাইকেল কারখানার প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রযোজন।
 
বিশ্বের উন্নত শহরগুলিতে হেঁটে চলাচলকারীদের সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে “পেডেস্ট্রিয়ান ফার্স্ট পলিসি” তৈরিসহ হাঁটার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। ঢাকা শহরের পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রণীত ও গৃহীত স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লান (এসটিপি)-কে “পেডেস্ট্রিয়ান ফার্স্ট পলিসি” বলা হয়েছে যা এর সুপারিশ ও অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়নি। এসটিপিতে পথচারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র সত্তর কোটি (১০ মিলিয়ন ইউএস ডলার)। যা পরিমাণে খুবই সামান্য। তাছাড়া পথচারীদের উন্নয়নে কবে কখন কি ধরনের কাজ করা হবে সে বিষয়ে কোন সুষ্পষ্ট দিক-নির্দেশনা নেই। এ বিষয়টি গুরুত্ব সহাকারে পূণর্মূল্যায়নের প্রয়োজন। মানুষকে হেঁটে চলাচলে উৎসাহী করা, বিশেষ করে যারা হেঁটে চলাচল করে তাদের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা হলে অনেকগুলি সুবিধা অর্জন করা সম্ভব। এর মাধ্যমে যানজট এড়ানোর পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতা, পরিবেশের উন্নয়ন, জ্বালানী সাশ্রয় ও যাতায়াত খরচ কমিয়ে আনা যায়। সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ক্রমানুসারে হাঁটা, সাইকেল, রিকশা ও পাবলিক পরিবহণকে প্রাধান্য দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। মানুষকে হাঁটার জন্য বাধ্য করা নয়, উৎসাহ দিতে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
 
প্রাইভেট কারের প্রাধান্য ও আরো যে সমস্ত কারেণ হাঁটার এবং সাইকেল চালানোর অধিকার খর্ব হচ্ছে:
 
ঢাকার পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে সাধারণত যান্ত্রিক যানবাহন বিশেষ করে প্রাইভেট কারকে সার্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। অধিকাংশ মানুষের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরিসহ দূষণ, জ্বালানী ব্যবহার, দূর্ঘটনা, যাতায়াত খরচ, সড়ক ও অবকাঠমো ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা দেশের অর্থনীতি তথা সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। শুধুমাত্র অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ, যারা প্রাইভেট কার ব্যবহার করছে তাদের সুবিধা দিতে গিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাসের অভাবে বিদ্যূৎ উৎপাদন এবং অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
 
অথচ পরিবহণ ব্যবস্থায় প্রাইভেট কারের আধিক্যের কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জ্বালানী সম্পদের অপচয় হচ্ছে। এ সমস্ত সমস্যা এড়ানোর জন্য প্রাইভেট কারের নিয়ন্ত্রণ দরকার। এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহের মধ্যে হাঁটা এবং সাইকেলকে প্রাধান্য দিয়ে ফুটপাতের উন্নয়ন এবং সমতলে সড়ক পারাপারের সুবিধা সাইকেল চালানোর জন্য পৃথক লেন, পথ এবং স্ট্যান্ড নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকায় যে সমস্ত ফুটপাত রয়েছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাঙ্গা, অসমান এবং গাড়ী পার্কিং এর কারণে হাঁটার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ফুটপাত ও রাস্তায় গাড়ী পার্কিং করায় অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণভাবে মানুষ ফুটপাত ছেড়ে রাস্তার মধ্য দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে। ফুটপাতের পাশে ডাস্টবিন, কনস্ট্রাকশনের জিনিসপত্র-ময়লা-আবর্জনা হাঁটার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতার সৃষ্টি করছে। তাছাড়া সাইকেল চালানোর জন্য পথৃক লেন এবং গন্তব্যে পৌছানোর পর সাইকেল রাখার স্ট্যান্ড না থাকায় নিরাপত্তাহীনতার কারনে মানুষ হেঁটে, সাইকেরে চলাচলে নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
 
হেঁটে চলাচলের ক্ষেত্রে আরো একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, যান্ত্রিক যানবাহন বিশেষ করে প্রাইভেট কারের নির্বিঘেœ চলাচল নিশ্চিত করতে পথচারী পারাপারের জন্য তৈরী করা হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। আর রাস্তার মাঝখানে গ্রিল দিয়ে মানুষকে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার হতে বাধ্য করা হচ্ছে। মুছে ফেলা হয়েছে রাস্তা পারাপারের জন্য প্রয়োজনীয় জেব্রা ক্রসিং। যার ফলে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধি ও অসুস্থ ব্যক্তি এবং মালামাল নিয়ে সড়ক পারাপার করা পথচারীদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই ধরনের ব্যবস্থা মানুষকে যান্ত্রিক যানবাহনের উপর নির্ভরশীল করে তোলা হচ্ছে। যা যানজটসহ জ্বালানী নির্ভরতা, দূষণ, দূর্ঘটনা এবং যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি করবে। দেশের বাইরে যে সমস্ত দেশ সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে সে সব দেশে হাঁটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং হেঁটে চলাচলের জন্য সেখানে প্রশস্ত ফুটপাত রয়েছে। শুধু তাই নয় প্রতিবন্ধি, শিশু ও বয়স্কদের হেঁটে চলাচলের আলাদা নীতিমালা আছে। অনেক উন্নত শহরেই যাতায়াতের ক্ষেত্রে পথচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। পথচারী হেঁটে যাচ্ছে দেখলে গাড়ির গতি থামিয়ে তাকে আগে যেতে দেয়া হয়। ঢাকা শহরেও পথচারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে সমতলে সড়ক পারাপারের ব্যবস্থা করা জরুরী।
 
সুস্থতা ও সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য হাঁটার গুরুত্ব:
শুধুমাত্র যানজট সমস্যার সমাধানই নয়, শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের সাথে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা দরকার। কিন্তু আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনে নিয়মিত ব্যয়াম করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ব্যয়ামের জন্য যে সমস্ত জিম রয়েছে তাও ব্যায় সাপেক্ষ। অথচ আমরা যদি একটু সচেতন হয়ে অল্প দুরত্বে যাতায়াতের ক্ষেত্রে হেঁটে চলাচল করি তাহলে ব্যয়ামের জন্য আলাদা করে সময় বের করার প্রয়োজন হবে না, সেই সাথে অর্থ সাশ্রয় হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত হাঁটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট এবং ওজন কমানোর জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ১ ঘন্টা হাঁটা প্রয়োজন।
নিয়মিত হেঁটে চলাচলের মাধ্যমে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মোটাজনিত রোগসহ নানা ধরনের অসংক্রামক জটিল রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত তিনটি গবেষনায় দেখা গেছে নিয়মিত ৩০ মিনিট হাঁটলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যূর ঝুঁকি ৩৯% থেকে ৪৮% পর্যন্ত কমায়। ২০০৪ সালে আমেরিকায় ৯০৬ জন মহিলার উপর পরিচালিত জরিপের ফলাফল নিয়ে "ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব অসবৎরপধহ গবফরপধষ অংংড়পরধঃরড়হ" নামক গবেষনা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায় নিয়মিত হাঁটাচলা না করায় বা কায়িক শ্রমের অভাবে ৭৬% মহিলা অতিরিক্ত ওজনজনিত সমস্যা এবং ৪১% মহিলা মোটাজনিত সমস্যায় ভুগছে। অতিরিক্ত ওজন হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া এমন অনেক অসংক্রামক অনেক রোগ আছে যা হেঁটে চলাচলের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব। গবেষণা প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, নিয়মিত হাঁটার ফলে শারীরিক সুস্থতার সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা সম্ভব।
 
শুধুমাত্র সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যই নয়, হাঁটার মাঝে এক ধরনের আনন্দও রয়েছে। কারণ হাঁটতে গিয়েই পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখাশুনা এবং নতুন মানুষের সাথে খুব সহজে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব, যা সামাজিক আদান-প্রদান বৃদ্ধির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত হেঁটে চলাচল করলে আশপাশের সকলের সাথে সখ্যতা সৃষ্টি হয়, যা সামাজিক নিরাপত্তাও বৃদ্ধিতেও কাজ করে। তাছাড়া হেঁটে চলাচল করলে ধনী-গরিব এর মাঝে সাম্যবোধ সৃষ্টি হয়।
 
শিশুদের জন্য:
শুধুমাত্র বড়দের জন্যই নয়, শিশুদেরও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য হাঁটা, সাইকেলের উপকারিতা রয়েছে। শিশুদের ওপর নির্ভর করে আগামী দিনের ভবিষ্যত। অতএব তাদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে ঢাকা শহরে শিশুরা বড় হচ্ছে ইট-কাঠের তৈরী আবদ্ধ ঘরে। তাদের সময় কাটানোর মাধ্যম হচ্ছে টিভি, কম্পিউটার, ভিডিও গেমস ইত্যাদি। উপযুক্ত খেলাধুলা ও হাঁটার পরিবেশ না থাকার কারণে আশে পাশে কারো সাথে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে না। যা তাদের সুষ্ঠু বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়। এমনকি বিশেষ একটি শ্রেণী বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া অথবা অন্য কোথাও যাতায়াতের জন্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্রাইভেট গাড়ী ব্যবহার করছে। যা তাদের শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধার সৃষ্টি করছে। প্রাইভেট গাড়ীর সংকুলান করতে গিয়ে তারা কেড়ে নিচ্ছে অন্যের হাঁটার জয়াগা। সুতরাং প্রাইভেট গাড়ীর ব্যবহারকারীরাই নয়, বৃহৎ জনগোষ্ঠীরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। এছাড়া গাড়ি পার্কিং এর জায়গা দিতে গিয়ে বাসার কাছে অথবা স্কুলগুলোতেও পর্যাপ্ত খেলার জায়গা নেই। ফলে শিশুদের প্রয়োজনীয় শারীরিক ব্যায়াম হচ্ছে না। অথচ প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার কমালে হাঁটার জন্য এবং শিশুদের খেলাধূলার, সাইকেল চালানো পর্যাপ্ত জায়গা দেওয়া সম্ভব। তাহলে শিশুরা হেঁটে, সাইকেলে স্কুলে যাতায়াতের পাশাপাশি খেলাধূলার সুযোগ পাবে, যা তাদের শারীরিক ব্যয়াম এর পাশাপাশি অন্যদের সাথে মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
 
অর্থনীতি ও পরিবেশ বিবেচনা:
হেঁটে এবং সাইকেলে চলাচলের সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে যান্ত্রিক যানবাহনের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে সাহায্য করবে। যা জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার ও পরিবেশ দূষণও কমাবে। অতিমাত্রায় জ্বালানী নির্ভর যানবাহনের ব্যবহার, জ্বালানী নির্ভর যানবাহন তৈরির কলকারখানা থেকে সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ। হেঁটে, সাইকেলে চলাচলের মাধ্যমে জ্বালানী নির্ভর যানবাহনের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনলে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সহায়ক হবে। আমেরিকান শহরগুলিতে প্রাইভেট গাড়ি নির্ভর যাতায়াত ব্যবস্থা কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা বহুগুনে বৃদ্ধি করেছে। ফলে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ, ঘটছে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাড়ছে প্রাকৃতিক দূর্যোগ। আমেরিকা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ইউরোপের অনেক শহরেই প্রাইভেট গাড়ি নির্ভর যাতায়াত ব্যবস্থা এর অন্যতম কারণ। তবে বর্তমানে ইউরোপিয়ান বেশিরভাগ শহরেই প্রাইভেট গাড়ির উপর নির্ভরতা কমাতে হেঁটে, সাইকেলে চলাচল ও পাবলিক পরিবহণের সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
 
সাইকেল ব্যবহারের একটি উত্তম  উদাহরণ হচ্ছে ডেনমার্ক। বর্তমানে ডেনমার্কে সাইকেলে ৩৬ ভাগ যাতায়াত হয়। তারা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ২০১৫ সাল নাগাদ সাইকেলে ৫০ ভাগ যাতায়াত হবে। সেখানে তুষারপাতের মধ্যেও সাইকেল ব্যবহারকারীদের সত্তর ভাগ মানুষ সাইকেলে করেই যাতায়াত করেন। বিশ্বের ধনী দেশগুলির মধ্যে ডেনমার্ক অন্যতম। তাদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৩২.০০০ ইউরো। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এর জন্যই ডেনমার্কে সাইকেলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরকে আন্তরিক ও বসবাসযোগ্য করার লক্ষ্যে প্রাইভেট কারের ব্যবহার কমানোও সাইকেল ব্যবহারের অন্যতম কারণ। এছাড়া সেখানে পথচারী ও পাবলিক পরিবহণের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। ডেনমার্ক ছাড়াও বিভিন্ন শহরে ফ্রি সাইকেল সার্ভিস রয়েছে। সেক্ষেত্রে নগর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্দ্দিষ্ট কিছু স্থানে সাইকেল রাখা হয়। যেখান থেকে মানুষ সাইকেল নিযে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে সাইকেল ফেরত দিয়ে থাকে। এছাড়া “বাইক এন্ড রাইড সিস্টেম” অনেক স্থানেই খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই ব্যবস্থায় বাস/রেল স্টেশনে সাইকেলে রাখার বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। অনেকেই সাইকেল স্টেশনে রেখে পাবলিক পরিবহণের মাধ্যমে দূরে কর্মস্থলে যাচ্ছেন এবং ফিরতি পথে সাইকেল নিয়ে বাড়ী ফিরে থাকেন।
 
এছাড়া এশিয়ান শহরগুলিতে বেশিরভাগ যাতায়াত হেঁটে, জ্বালানীমুক্ত যান ও পাবলিক পরিবহণে হয়ে থাকে। ঢাকাতে সমন্বিত পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে জনসাধারণ কাঙ্খিত সুবিধা পাবেন। আর সেই সাথে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি আমরাও অবদান রাখতে পারব।
 
যান্ত্রিক যানবাহনের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পথচারীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে মিশ্র এলাকা গড়ে তোলা প্রয়োজন। মিশ্র এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার, কর্মস্থল, বাসা ও বিনোদনকেন্দ্র রাখাটা নিশ্চিত করতে হবে। নগরে অল্প দূরত্বের মধ্যে প্রয়োজন মেটাতে পারলে হেঁটেই বেশিরভাগ যাতায়াত করা সম্ভব। পাশাপাশি সাইকেল, রিকশা ও পাবলিক পরিবহণের উন্নয়ন এবং প্রাইভেট কারের নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
 
ফুটপাত ও হকার প্রসঙ্গ:
পরিকল্পিত ফুটপাত শুধুমাত্র স্বচ্ছন্দে হেঁটে যাতায়াতের জন্য নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফুটপাতে হকার ব্যবসার মাধ্যমে দেশে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এদের সুশৃঙ্খলভাবে বসার ব্যবস্থা করার মধ্যে দিয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মাধ্যমে আরো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। বেকারত্ব হ্রাস পেলে সামাজিক অপরাধও কমে আসে। তাছাড়া ফুটপাতে হকার থাকলে তাদের সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্র হেঁটে এবং সাইকেলে চলাচলকারীদের আকর্ষণ করে এবং মানুষ সস্তায় জিনিসপত্র কিনতে পারে। ফুটপাতে হকার নিরাপত্তা কর্মীর দায়িত্ব পালন করে। সুতরাং হেঁটে চলাচলে উৎসাহী করতে ফুটপাতে হকারদের ব্যবসা করার জন্য নিয়ন্ত্রিতভাবে বসা ও তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যা তাদের জীবন মানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
 
 
হাঁটা এবং সাইকেলে চলাচলের পরিবেশ উন্নয়নে যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন:
* অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হাঁটার সুবিধা বৃদ্ধিতে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
* শহরের সকল এলাকায় হাঁটার পরিবেশ তৈরি করা।
* ফুটওভার ব্রিজ না করে, জ্রেবা ক্রসিং বা সিগন্যাল সিষ্টেম উন্নত করা। পথচারীদের নির্বিঘেœ রাস্তা পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং এর পূর্বে গাড়ি থামানো। যাতে সব মানুষ বিশেষ করে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, শারীরিক প্রতিবন্ধী বা অসুস্থ ব্যক্তিরা সহজে রাস্তা পার হতে পারে।
* ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ করা এবং কার্যকরভাবে তা বাস্তবায়ন করা।
* দূর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ হাঁটার পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্যে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
* ফুটপাত কনস্ট্রাকশনের জিনিসপত্র এবং ময়লা-আবর্জনামুক্ত রাখা।
* ফুটপাত প্রশস্ত করা ও ছায়ার জন্য পর্যাপ্ত গাছ লাগানো ও সংরক্ষণ এবং আলোর ব্যবস্থা করা।
* শহরের সর্বত্র সাইকেলে চলাচলের জন্য নেটওয়ার্ক তৈরি করা।
* সাইকেলের জন্য পৃথক লেন ও পথ তৈরি করা।
* সাইকেলের জন্য স্ট্যান্ড তৈরি করা।
* সাইকেলের উপর আরোপিত কর কমানো।
* ফ্রি সাইকেল সার্ভিস চালু করা।
* “বাইক এন্ড রাইড সিস্টেম” চালু করা।
* পথচারী, রিকশা ও পাবলিক বাসে চলাচলের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা।
* সকল এলাকায় যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রিত রেখে সুশংখলভাবে চলাচলের ব্যবস্থা করা। দিনের ব্যস্ততম সময়ে কিছু এলাকায় আংশিক গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করা। যেমন- হাসপাতাল, স্কুল এবং মার্কেট এলাকা।
 
* পথচারীদের চলাচলে উৎসাহী ও অপরাধের হাত থেকে নিরাপদ করতে ফুটপাতে সুশৃংখলভাবে ছোট দোকান বা হকারদের
* বসার ব্যবস্থা করা।
* পরিবহণ পরিকল্পনা গ্রহনের ক্ষেত্রে ফুটপাতের পাশে জ্বালানিমুক্ত যানবাহন (সাইকেল, রিকশা) চলাচলকে প্রাধান্য দেয়া।
* মাস/সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে কোন কোন এলাকায় আংশিক বা পুরো সময় যান্ত্রিক যান নিষিদ্ধ করে শুধুমাত্র হেঁটে, সাইকেলে ও রিকশায় চলাচলের ব্যবস্থা করা।
* একদিন বেজোড় সংখ্যা ও অন্যদিন জোড় সংখ্যার লাইসেন্স অনুযায়ী প্রাইভেট কার চলাচলের ব্যবস্থা করা।
* জায়গা ও সময়ের মূল্যানুসারে পার্কিং চার্জ আদায় করা।
* প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণে লাইসেন্স সীমিতকরণ, আমদানী নিয়ন্ত্রণ ও কর বৃদ্ধি করা।
* নগরের কেন্দ্র, বানিজ্যিক এবং ব্যস্ত এলাকা প্রাইভেট কারমুক্ত করা।
* নগরীর ব্যস্ত এলাকায় প্রাইভেট কার প্রবেশের জন্য কনজেশন চার্জ গ্রহণের ব্যবস্থা করা।
 
নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করা হোক অধিকাংশ মানুষের সুবিধাকে। ইট, পাথর, বালি, গাড়ী, যানজট, শব্দ ও বায়ূদূষণের পরিবর্তে মানুষের বসবাসের জন্য পরিবেশ বান্ধব নগর গড়ে তোলাই হোক আমাদের লক্ষ্য। যেখানে আমাদের শিশুরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারবে, মানুষে মানুষে থাকবে অটুট বন্ধন, নিশ্চিত হবে সামাজিক সমতা, অগ্রাধিকার পাবে অধিকাংশ মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যে ও সহজে চলাচলের ব্যবস্থা।

সৈয়দ মাহবুবুল আলম