রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধিরোধে অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ করতে হবে

রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধিরোধে অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ করতে হবে

রাজধানী শহর ঢাকা ধীরে ধীরে একটি উষ্ণ এলাকায় পরিণত হচ্ছে। নগরায়ন প্রক্রিয়ায় পরিকল্পনার অভাবে এবং অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের ফলে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাছপালা ও জলাভ’মি ধ্বংস করে আমরা রাজধানী ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ঢাকার পরিবেশ, জনজীবন ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধিরোধে অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ বাচাঁও আন্দোলন(পবা) ’র ঢাকায় এলাকাভেদে তাপমাত্রার তারতম্য নিরূপণের লক্ষ্যে ১১-১৮ এপ্রিল ২০১৬ সময়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্র্ াজরিপের আলোকে এই দাবী জানানো হয়। আজ ১৯ এপ্রিল ২০১৬, মঙ্গলবার, সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদনের আলোকে বক্তব্য রাখেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান। পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরী, সহ-সম্পাদক মো: সেলিম বিআইডব্লিউটিএ-র সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, স্থপতি শাহীন আজিজ, প্রকৌশলী আবদুস সাত্তার, প্রমুখ।

প্রতিবেদনে বলা হয় - বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরী বিশ্বের দ্রুততম বর্ধমান মেগাসিটি এবং এর বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লক্ষ, ১৯৯০ সালে ৬০ লক্ষ, ২০০৫ সালে ১ কোটি ২০ লক্ষ। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা হবে ২ কোটি । ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ, জনজীবন ও জনস্বাস্থ্য আজ বিপর্যস্ত। এর প্রধান কারণ হচ্ছে - জনসংখ্যার চাপ; অপরিকল্পিত নগরায়ন; নদী-খাল, জলাভ’মি ও নি¤œাঞ্চল দখল ও ভরাট; খেলার মাঠ ও উম্মুক্ত স্থান দখল; প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দূষণ, ভ’গর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত উত্তোলন, বায়ু দূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ইত্যাদি।
         

বর্তমান দেশে অস্বাভাবিক গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বে ১০০ বছরের  মধ্যে  এ বছরের মার্চ মাসে তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ১.৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড । দেশের অন্যান্য জেলার মত ঢাকার তাপমাত্রাও  প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যার আধিক্য; নি¤œমানের গণপরিবহন; যানবাহন ও জেনারেটরের ধোঁয়া; বিভিন্ন ভবন ও যানবাহনের এসির বাতাস; পাকা ভবন ও রাস্তাঘাট; সবুজ চত্তর ও গাছপালার অভাব; উন্মুক্ত স্থান, মাঠ, পার্ক ও লেকের অপর্যাপ্ততা, নি¤œাঞ্চল ও জলাভ’মির স্বল্পতা, বৈশ্বিক উঞ্চতা ও জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ এধরনের শহর পৃথিবীতে বিরল। দূষণ, দখল, ভরাটের ফলে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো আজ মৃত প্রায় এবং এগুলোর অস্তিত্ব হুমকীর সম্মুখীন। অন্য দিকে এ শহরে যে পরিমান নি¤œাঞ্চল রয়েছে তার প্রায় ৭০% ইতিমধ্যে ভরাট করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পাল্লা দিয়ে চলছে ভরাট কার্যক্রম। ভরাটের এ গতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শতভাগ নি¤œাঞ্চল হারিয়ে যাবে। ঢাকার নি¤œাঞ্চল এবং চারদিকে নদীগুলো ছাড়া যে জলাভ’মি রয়েছে তা হচ্ছে লেক। লেক পরিবেশগত সুফল প্রদান করে, জীবনের গুণগত মান উন্নয়নে প্রভাব ফেলে এবং বিশাল পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করে, খরা ও বন্যার প্রভাব থেকে রক্ষা করে।

প্রকৃতির প্রাচুর্যের সাথে বিশাল উম্মুক্ত জাগার কারণে এক সময়ে ঢাকাকে বলা হতো ‘প্রাচ্যের ভেনিস’। ব্রিটিশ আমলে ঢাকা উত্তর দিকে সম্প্রসারিত হতে থাকলেও সবুজ এলাকা শহরের সীমানার ভেতর অন্তর্ভূক্ত ছিল। একটি সবুজ এলাকা শহরের কেন্দ্রে উম্মুক্ত রাখা হয়েছিল। রমনা পার্ক ১৯০৮ সালে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্রুত নগরায়নের সাথে সাথে উম্মুক্ত জায়গার পরিমাণ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। সরকাবি ও বেসরকারি উভয় খাতের অসংবেদনশীলতার ফলে উম্মুক্ত এলাকা ও জলাশয় দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে একটি আদর্শ নগরীর জন্য ২৫% উম্মুক্ত এলাকা রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পুরানো ঢাকায় ৫% এবং নতুন ঢাকায় ১২% এলাকা সবুজ ও উম্মুক্ত (ডিএমডিপি ১৯৯৫)। ঢাকা স্ট্রাকচার প্লানে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ২০% উম্মুক্ত এলাকা রাখা হয়েছে (ডিএমডিপি ১৯৯৫)। কিন্তু বাস্তবে এলক্ষ্যে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। এসব এলাকা সরকারি ও বেসরকারিভাবে দখলের ফলে প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে।


ঢাকায় ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ পর্যন্ত নিবন্ধনকৃত মোটরযানের সংখ্যা ৯,৬৪,৩৯৪টি। কংক্রিটের সড়ক ও মোটরচালিত যানবাহন থেকে নির্গত তাপ শহরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মনিটরিংয়ে দেখা যায় যে গত ১০০ বছরে বাংলাদেশে তাপমাত্রা ০.৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেলেও ঢাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গাছপালা একদিকে তাপ শুষে নেয় অন্যদিকে শীতল অক্সিজেন সরবরাহ করে। জলাভ’মিও তাপ শোষণ করে। অত্যন্ত পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, আমরা গাছপালা ও জলাভ’মি দুটোই ধ্বংস করছি এবং রাজধানী ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ঢাকায় এলাকাভেদে তাপমাত্রার তারতম্য নিরুপণের লক্ষ্যে ১১-১৮ এপ্রিল ২০১৬ সময়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা জরিপ করে। জরিপের ফলাফলে দেখা যায় যে, ধানমন্ডি লেক এলাকার চেয়ে ঢাকার যে কোন এলাকার তাপমাত্রা ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি বেশি। এলাকাভেদে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা পাওয়া যায় পল্টন মোড়, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ১নং গেইট, শাপলা  চত্ত্বর, নিউ মার্কেট বাসস্ট্যান্ড এলাকায়, যা অন্যান্য এলাকার চেয়ে ১.৫ থেকে ৪ ডিগ্রি বেশি। এর প্রধান কারণ মোটরযানের ধোয়া ও এসির গরম বাতাস, পাকা রাস্তার গরম। রাস্তার পাশে ফুটপাতে বা ছায়ার চেয়ে রাস্তার মাঝখানে বা রোদে তাপমাত্রা ১ থেকে ২.৫ ডিগ্রি বেশি। বাসের ভিতরে পিছনের চেয়ে সামনে তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি। বাস সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করাই এর প্রধান কারণ। ঢাকায় থার্মোমিটারে যে তাপমাত্রা পাওয়া যায় বাস্তবে ঢাকার জনজীবনে  অনুভ’ত তাপমাত্রা  ৩ থেকে ৮ ডিগ্রি বেশি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পানির অভাব। গরমে তৃষ্ণা মেটাতে রাস্তাঘাটে যে পানীয় পান করছে তাও নিরাপদ নয়। পানিবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নগরবাসীর যে কোন পানীয় পান থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।

ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি মোকাবেলার পাশাপাশি ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নি¤বর্ণিত সুপারিশ তুলে ধরা হলো ঃ
ক্স    আবহাওয়া অধিদপ্তর কর্তৃক বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত প্রতি ঘন্টার তাপমাত্রা জনগণকে অবহিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ক্স    আবহাওয়ার পূর্ববাস গণমাধ্যমের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়মিত প্রচারের ব্যবস্থা করা।
ক্স    কংক্রিটের জঙ্গলে যেখানেই সুযোগ রয়েছে সেখানেই গাছ লাগানো।
ক্স    এখনও যে খেলার মাঠ, ছোট-বড় পার্ক, লেক, নি¤œাঞ্চল- জলাভ’মি, উম্মুক্ত স্থান রয়েছে তা সংরক্ষণ করা।
ক্স    শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, খেলার মাঠে আম, কাঁঠাল, জাম, আমড়া ইত্যাদি দেশীয় গাছ রোপণ করা।
ক্স    ঢাকার আবহাওয়া শীতল রাখার জন্য আরো কিছু লেক গড়ে তোলা।
ক্স    বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে গাছ লাগানোর জন্য কিছু জায়গা ছেড়ে দেয়ার বিধান করা। এক্ষেত্রে রাজউক এবং ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কার্যকর ভ’মিকা রাখা।
ক্স    বহুতল ভবনের ছাদের নির্দিষ্ট একটি অংশে বাগান সৃজন বাধ্যতামূলক করা।